শওকত আহসান ফারুক: আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন নিয়ে পড়েছি। বেড়ে উঠা কুমিল্লা শহরে, শৈশব কেটেছে জন্মভুমি হাটখোলা কুমিল্লা গ্রামের বাড়িতে। শহর ও গ্রামের রসায়ন নিয়ে গড়েছি নিজের জীবন।
এখন আবসর জীবন যাপন করছি। পঁয়ষট্টি বৎসরের জীবনে ফিরে দেখা অতীত ও ঐতিহ্য নিয়ে লিখছি, রুম নাম্বার ১৪৬। সেটিকেই এখানে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা।
১৪৫.
প্রবীন রাজনিতীবিদ কুটনেতিক ব্যক্তিত্ব পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডঃ এম.এ মালিক’ ৯ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি জানিয়ে এক বার্তায় লিখেছিলেন, ‘সামরিক পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়েছে, পশ্চিমে শত্রু ফরিদপুরের কাছে চলে এসেছে এবং পূর্বে লাকসাম ও কুমিল্লায় আমাদের বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে মেঘনা নদীর ধারে পৌঁছেছে। এখনও যদি বাইরের সাহায্য না আসে, তবে শত্রু যে কোনো দিন ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে যাবে। পুনরায় আপনাকে বলছি, আশু যুদ্ধবিরতি ও রাজনৈতিক সমাধানের কথা বিবেচনা করুন।’
গভর্নর মালিকের সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল রাও ফরমান আলী ও মুখ্য সচিব ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করে ঢাকায় অবস্থিত জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে ‘আত্মসমর্পণের’ আবেদনপত্র হস্তান্তর করেছিলেন, এতে অবশ্য কৌশলে আত্মসমর্পণ’ শব্দটি বাদ দিয়ে অস্ত্রসংবরণ’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছিলো।এই আবেদনে আরো লেখা ছিল, ‘যেহেতু সংকটের উদ্ভব হয়েছে রাজনৈতিক কারণে, তাই রাজনৈতিক সমাধান দ্বারা এর নিরসন হতে হবে। আমি তাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির দ্বারা অধিকারপ্রাপ্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ঢাকায় সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানাই। আমি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জাতিসংঘকে আহ্বান জানাই।’
এই আবেদন পত্রটি ঢাকায় অবস্থানরত জাতিসংঘের প্রতিনিধি ‘পল মার্ক হেনরির’ কাছে দেওয়া হয়েছিলো। সর্ব মহলে বার্তাটি ‘মালিক-ফরমান আলী’ বার্তা নামে পরিচিতি পেয়েছিলো, অজানা কারণে, পরের দিন সেই বার্তা আবার প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিলো।
মুক্তিযোদ্ধা, মিত্রবাহিনী, কাদেরিয়া বাহিনী ঢাকা ঘেরাও করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার জন্যে বার বারর আহবান করছিলো। মিত্রবাহিনী কর্তৃক গভর্নর হাউজে উপর্যুপরি বোমাবর্ষণে, গভর্নর মালিকের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের সরকার, ১৪ ডিসেম্বর পদত্যাগ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গিয়েছিলো। শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণের আহবান জানিয়ে আকাশ থেকে অনবরত প্রচারপত্র ফেলা হয়েছিলো।
নিয়াজির অনুরোধে, ১৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে পরদিন সকাল সাড়ে নয়টা পর্যন্ত ভারতীয় বিমান আক্রমণ স্থগিত ছিলো। পরদিন সকালে বিমান আক্রমণ বিরতির সময়সীমা শেষ হওয়ার কিছু আগে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জাতিসংঘের প্রতিনিধি জন কেলির মাধ্যমে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষকে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির সময়সীমা আরও ছয় ঘণ্টার জন্য বাড়িয়ে দেবার অনুরোধ করেছিলে। তিনি আরো বলেছিলেন, ভারতের একজন স্টাফ অফিসারকে ঢাকায় পাঠানোর জন্য, আবেদন জানিয়ে ছিলেন।
অস্ত্রসমর্পণের ব্যবস্থাদি গ্রহন করার জন্য ছিলো এই আবেদন।
১৪৬.
জেনারেল নিয়াজীর আবেদনের পরিপেক্ষিতে, পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের দলিল এবং সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করার জন্য ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অব স্টাফ চৌকস অফিসার, ইহুদি বংশভুত মেজর জেনারেল জ্যাকব দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন, জ্যাকব মধ্যাহ্নে ঢাকায় এসে পৌঁছে, জেনারে নিয়াজীর সাথে এক দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন।
সেই বৈঠকে নিয়াজীকে বলেছিলেন, তোমরা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ, আত্মসমর্পণ ছড়া আর কোন বিকল্প নেই। তোমাদের অনেকের সাথে রয়েছে তোমাদের পরিবারের, মুক্তিবাহিনী প্রতিশোধে গ্রহনের জন্য মরিয়া, আর কোন বিদেশী সাহায্যের আশা নেই। সারেন্ডার করো এটাই তোমাদের জন্য মঙ্গল। নিয়াজী প্রথম অবস্থায় উত্তেজিত এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলো।
কিন্তু পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে জ্যাকব বলেছিলেন, আমি কথা দিচ্ছি, জেনেভা কনভেনশন নীতি মেনেই সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। এখন তোমার কাছে দুটো অপশন হ্যা অথবা না। মনে রেখো এখানে তোমাদের প্রায় এক লক্ষ সৈন্যসহ রযেছে নিরীহ তোমাদের পরিবারবর্গ। তোমাকে হাফ এন অাওয়ার সময় দেওয়া হলো। সিদ্ধান্ত নেবার জন্য, জাস্ট তিরিশ মিনিট।
নিয়াজী নির্বাক, ‘মৌনতাই সম্মতির লক্ষন’ অর্থাৎ সারেন্ডার।
বিকেলের মধ্য বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীর দুই ইউনিটসহ মোট চার ব্যাটালিয়ন সৈন্য ঢাকায় প্রবেশ করেছিলো। সঙ্গে কয়েক সহস্র মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকার জনবিরল পথঘাট ক্রমে ক্রমে জনাকীর্ণ হয়ে উঠেছিলো। ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে মুখরিত ঢাকার জনপদ। বিকেল চারটায় ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান ও ভারত-বাংলাদেশ যুগ্ম-কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, বাংলাদেশের ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে খন্দকার এবং ভারতের সশস্ত্রবাহিনীর প্রতিনিধিগণ ঢাকায় অবতরণ করেছিলেন।
নিয়াজির আত্মসমর্পণে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবার পরেই ভারতের প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, পূর্ব ও পশ্চিম উভয় রণাঙ্গনে ভারতের পক্ষ থেকে এককভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিলেন।
১৪৭.
১৬ ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকার রেসকোর্সে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি হাজার হাজার উৎফুল্ল জনতার সামনে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। প্রায় ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছিলো সেইদিন। এটা ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্ববৃহৎ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। সেই দলিলে মিত্রবাহিনীর পক্ষে মিত্রবাহিনী প্রধান জেনারের জগজিৎ সিং অরোরা, মুক্তিবাহিনীর ও বাংলাদেশের পক্ষে এ.কে খন্দকার, পাকিস্তানির পক্ষে জেনারেল নিয়াজী সাক্ষর করেছিলেন।
১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের দিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ প্রান্তে প্রবেশ করেছিলো। কিন্তু বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের দখল থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে গেছে।
আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত বিজয় এলো ১৬ ডিসেম্বর। নয় মাস মুক্তিযুদ্ধে পর। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকেই শুরু, তিলে তিলে জমে উঠা ক্ষোভ, দ্রোহ, শাসন, শোষণ, নিপীড়ন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পক্ষান্তরে জনযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিলো। হাজার বছরের শেষ্ঠ বাঙ্গালী শেখ মুজিবর রহমান ৭ ই মার্চ এই রেসকোর্সে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ সেই রেসকোর্সে যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলো পাকিস্তান।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করলেও সারা দেশে সকল পাকিস্তানি সৈন্যকে আত্মসমর্পণ করাতে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লেগে গিয়েছিলো। ঢাকার মিরপুর ডিসেম্বরের ২৭/২৮ তারিখে শত্রুমুুক্ত হয়েছিলো, পাকিস্তান সমর্থিত বিহারী রিফিউজিরা সেখানে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে ছিলো।