শওকত আহসান ফারুক: আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন নিয়ে পড়েছি। বেড়ে উঠা কুমিল্লা শহরে, শৈশব কেটেছে জন্মভুমি হাটখোলা কুমিল্লা গ্রামের বাড়িতে। শহর ও গ্রামের রসায়ন নিয়ে গড়েছি নিজের জীবন।
এখন আবসর জীবন যাপন করছি। পঁয়ষট্টি বৎসরের জীবনে ফিরে দেখা অতীত ও ঐতিহ্য নিয়ে লিখছি, রুম নাম্বার ১৪৬। সেটিকেই এখানে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা।
১৫৪.
সিমলা চুক্তিতে নিম্ম বিষয় গুলো অন্তর্ভুক্ত ছিলো।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে সর্বশেষ পাকিস্তান আর্মি ভারতীয় সেনাদের নিকট অস্ত্র সমর্পনের সময় কাশ্মীর সীমান্তে দুই দেশের সৈন্য যে যেই অবস্থান রয়েছে সেটাই সেই দেশের সীমানা হবে, এই সীমানাকে ভারত পাকিস্তান এল.ও.সি ‘ লাইন আব কন্ট্রোল’, উভয়ে এটা মেনে নিয়েছিলো।
সিমলা চুক্তির অনুযায়ী ভারত পাকিস্তানী ৯৩ হাজার বন্দী সেনাদের মুক্তি দিয়েছিলো এই শর্তে যে যুদ্ধঅপরাধিদের বিচার পাকিস্তান নিজেই করবে, যারা বাংলাদেশে যুদ্ধকালীন সময়ে অপরাধে সাথে জড়িত ছিলো।
পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে ভারতের দখলকৃত অঞ্চল ভারত ছেড়ে দিয়েছিলো বিনা শর্তে এবংভবিষ্যতে ভারত পাকিস্তান কোন সমস্যা সমাধানে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা থেকে দুই দেশই বিরত থাকবে।
দুই দেশর সেনারা কোন ভাবেই এল.ও.সি সীমানা অতিক্রম না করার অঙ্গীকার করেছিলো। সাধারণ জনগণের আসা যাওয়ার জন্য বর্ডার খোলা থাকবে যাতে করে দুই দেশের জনগণের আত্বীয় পরিজনের সাথে মিলিত হতে পারে।
পাকিস্তান ভারতের কাছে আরও একটি বিষয়ে অঙ্গীকার বা সমঝোতা করেছিলো, যা চুক্তির দলিলে উল্লিখিত ছিলো না। এতে ছিল সত্তর পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান এবং বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে আটকে পরা নাগরিকদের নিজ নিজ দেশে ফিরে যাবার লক্ষ্যে দ্রুত সংলাপ শুরুর ব্যবস্থা করা।
উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে সমঝোতা সিমলা চুক্তিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান জোরাল সমর্থন জানিয়েছিলেন।
১৫৫.
সিমলা চুক্তি হবার পরেও উপমহাদেশে উদ্ভত ভয়বাহ মানবিক পরিস্থিতির তেমন কোন উন্নতি হয়নি, তার সবচেয়ে বড় অন্তরায় ছিলো পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম হিসাবে স্বীকৃতি না দেওয়াতে। উপমহাদেশে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে পাকিস্তানের সাথে কোন বৈঠকে অংশগ্রহণ করতে না পারায় যুদ্ধোত্তর মানবিক সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছিলোনা। এই মানবিক সমস্যা সমাধানে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হিসেবে ভারত এবং পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ছিল সবেচেয়ে বেশি জরুরী।
সিমলা চুক্তি সময় যে সমঝোতা হয়েছিলো যে পাকিস্তান বাংলাদেশকে মেনে নিবে সেই কথা রাখেনি এবং ইন্দির গান্ধীর মহানুভবতা সুযোগ ভুট্টো ভালোই নিয়েছিলো ভুট্টোর সঠতা সুস্পষ্ট।
বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে আটকে পড়া দুই দেশের লক্ষ লক্ষ নাগরিকের প্রত্যাবর্তন এবং ভারতে আটক ৯২ হাজার সৈন্য ফেরত পাঠানোসহ নানাবিধ মানবিক সমস্যা সমাধানে ভারত এবং বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে একটি জোরাল উদ্যোগ নিয়েছিলো।
১৭ এপ্রিল ভারত বাংলাদেশ একটি যৌথ ঘোষনা দিয়েছিলো তাতে বলা হয়েছিলো, উপমহাদেশে উত্তেজনা কমিয়ে স্থায়ী শান্তি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে দুই দেশ বন্ধুত্ব এবং সম্প্রীতি বজায় রেখে কাজ করে যাবে। সেই ঘোষনায় প্রস্তাব করা হয়েছিলো যে, আটককৃত এবং আটকে পড়া নাগরিকদের স্ব স্ব দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে দেখা উচিত।
তবে বন্দী ঐসব পাকিস্তানী সৈন্য যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, তাদের বাংলাদেশে বিচারের প্রয়োজন হতে পারে তাদের ক্ষেত্রে এই মানবিক দৃষ্টিকোণের বিষয়টি প্রযোজ্য হবে না।
এই ঘোষনার পরবর্তী সময়ে ভারত-বাংলাদেশ এবং ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছিলো। বৈঠক শেষে ১৯৭৩ সালের ২৮ আগস্ট একটি সমঝোতায় আসে তিনটি দেশ এবং বাংলাদেশের সম্মতির ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয় বিদ্যমান মানবিক সমস্যা সমাধানে।
এই সমঝোতার ফলে ১৯৭৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে তিন দেশের মধ্যে আটকে পড়া এবং বন্দী প্রত্যর্পন শুরু হয়। প্রায় ৩০ লাখ নাগরিক তাদের স্ব স্ব দেশে ফেরার সুযোগ পেয়েছিলো। এর ফলে তিন দেশের মধ্যে বিরাজমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি শান্ত হয় এবং উপমহাদেশে শান্তির পথে অগ্রগতি শুরু হয়েছিলো।
১৫৬.
‘অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স’, একটি আন্তর্জাতিক ইসলামিক সংস্থা। এই সংস্থা প্রতিষ্ঠিার পটভুমি ছিলো, ইজরাইল ফিলিস্তিনের জেরুজালেমে ১৯৬৯ সালের ২১ অগাস্ট পবিত্র মসজিদ, ‘মসজিদুল আকসায়’ অগ্নিসংযোগ করলে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিলো।
তাৎক্ষণিক ২৫ অগাস্ট ১৪ টি মুসলিম দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী গন মিসরের কায়রোতে এক বৈঠকে মিলিত হয়ে একটি সংস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনিয়তা অনুভব করেছিলেন। সৌদিআরব প্রস্তাব করেছিলো যেহেতু বিষয়টি স্পর্শকাতর সেহেতু সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান দের নিয়ে শীর্ষ বৈঠকের আয়োজন করার প্রয়োজন।
পশ্চিম আফ্রিকা, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের ২৫ টি দেশ মরক্কোর রাববাতে ১৯৬৯ সালের ২২-২৫ সেপ্টেম্বর প্রথম ও.আই.সি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। পাকিস্তান, ইরান, সৌদিআরব, সোমালিয়া, মিশর, নাইজেরিয়া, মালয়েশিয়া প্রমুখ দেশ ছিলো উদ্যোগী ভূমিকায়। মূলতঃ মুসলমানদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রতিনিধিত্ব করারর জন্য সোচ্চার আন্তরজাতিক এই সংস্থা।
১৯৭৪ সালে ২২-২৪ ফেব্রুয়ারি, লহোরে অনুষ্ঠিতব্য দ্বিতীয় ও.আই.সি সম্মেলনের প্রস্তুতিকালীন সময়ে, মুসলিম বিশ্ব থেকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর উপর, এই মর্মে চাপ আসে, তিনি যেন বাংলাদেশ কে আসন্ন ও.আই.সি সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ করেন, ফেব্রুয়ারি ১৬ তারিখ এক ঘোষনায় ভুট্টো বলেছিলেন, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পারে শুধু একটা শর্তে।
শর্তটি ছিলো, ভরতে আটক ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা যারা যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত, বাংলাদেশ তাদের বিচারের কোন পদক্ষেপ নিতে পারবে না। ২২ ফেব্রুয়ারী, পাকিস্তান, ইরান এবং তুরস্ক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে তাৎক্ষণিক একটি বিষেশ বিমান যোগে শেখ মুজিবর রহমান ২৩ ফেব্রুয়ারি লাহোর পৌঁছান ও.আই.সি সম্মেলনে যোগ দিতে।
বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা, ও.আই.সি-তে বাংলাদেশের যোগদান। শেখ মুজিবুর রহমান সম্মেলনে যোগ দিতে গেলে লাহোরে পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রীকে যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার দিয়ে বরণ করেছিলেন। পাকিস্তানের ভুমিতে প্রথম উচ্চারিত হয়েছিলো,