মোস্তাফা জব্বার: ৫জি প্রযুক্তির পাশাপাশি দুনিয়াতে বিকাশমান অন্যান্য প্রযুক্তির কথাও আমাদের মনে রাখা দরকার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিক্স নিয়ে দুনিয়াতে আলোচনা চলছে বহুদিন ধরে। তবে ৫জির মতো ব্রডব্যান্ড সংযুক্তির সময়কালে বা প্রযুক্তির উৎকর্ষতাকে বিবেচনায় নিলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স বা মেশিন লার্নিং সম্পূর্ণভাবেই একটি নতুন অভিজ্ঞতার যুগে আমাদের দেশটাকে নিয়ে যাবে।
বস্তুত সারা বিশ্বের রূপান্তর থেকে আমরা আলাদা থাকতে পারবোনা বলে এইসব প্রযুক্তির পাশাপাশি আমাদেরকে বিগডাটা, ব্লক চেইন এবং আইওটির মতো প্রযুক্তিকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সাম্প্রতিককালে যখনই কোন প্রযুক্তি বিষয়ক সেমিনারে যাই তখনই বলা হয় চালকবিহীন গাড়ি বা কারখানার রোবট যুক্ত হবার ফলে দুনিয়া পাল্টে যাবে। আমি নিজেও ভাবি যদি এমন হয় যে রোবট দিয়ে পোশাক কারখানা চালানো যায় তবে আমরা বিশ্বের পোশাক কারখানা থাকবো কেমন করে। যদি চালকবিহীন গাড়ি প্রচলিত হয়ে যায় তবে আমার নিজের দেশর কর্মসংস্থানতো বটেই বিদেশে যারা গাড়ি চালিয়ে বাংলাদেশে পেট চালান তাদের কি হবে? প্রশ্ন ওঠেছে যে আইওটি কি পাহারাদার-দারোয়ানের কাজটাও দখল করে নেবে? বিগ ডাটা কি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য নামক কোন কিছুই গোপন রাখবেনা?
শিল্প বিপ্লব ৪.০: খুব কষ্ট করার দরকার নেই, কেবল গুগলে অনুসন্ধান করলেই শিল্প বিপ্লব ৪.০ বা ডিজিটাল শিল্প বিপ্লব বিষয়ে অনেক তথ্যই পেয়ে যাবেন। জার্মান সরকারের উৎপাদনশীলতাকে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক করার একটি প্রকল্প থেকে ইনডাস্ট্রি ৪.০ শব্দটির সূচনা হয়। ২০১১ সালের সিবিট মেলায় শব্দটির পুনর্জন্ম হয় এবং ২০১২ সালের একই মেলায় কর্মশালার মধ্য দিয়ে জার্মান সরকারের কাছে এই বিষয়ক অনেকগুলো সুপারিশ পেশ করা হয়। ২০১২ সালে যে ওয়ার্কিং গ্রুপটি প্রাথমকি সুপারিশ পেশ করেছিলো তারা ৮ এপ্রিল ২০১৩ সালে এর চূড়ান্ত সুপারিশ পেশ করে।
এই ওয়ার্কিং গ্রুপটিকে ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এর জনক বলে গণ্য করা হয়। শিল্প বিপ্লবের এই ধারাটির ৪টি মৌলিক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা হয়।
ক) পারস্পরিক সংযুক্ত বা ইন্টারঅপারেবিলিটি: এই বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানুষ ও যন্ত্রের পারস্পরিক সংযুক্ত বা একইসূত্রে কাজ করার বিষয়টি শিল্প উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে থাকবে। ইন্টারনেট অব থিংস বা আ্ওটিকে এই সংযুক্তির কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। একে অবশ্য বলা হচ্ছে আইওপি বা ইন্টারনেট অব পিপল।
খ) তথ্য স্বচ্ছতা বা ইনফরমেসন ট্রান্সপারেন্সি: অপরিশোধিত সেন্সর ডাটাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা যাতে বিদ্যমান বস্তুগত বিশ্বকে উপাত্ত আকারে স্বচ্ছতার সাথে ব্যবহার করা যায়।
গ) কারিগরি সহায়তা বা টেকনিক্যাল অ্যাসিস্টেন্স: প্রযুক্তিকে মানুষের জন্য ব্যবহার করতে পারা। মানুষ কাজ করার জন্য বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ শক্তি কাজে লাগাবে। যেসব কাজ মানুষের পক্ষে করা ক্লান্তিকর, ঝুকিপূর্ণ, অপ্রিয় সেইসব খাতে প্রযুক্তি ব্যবহার করা।
ঘ) বিকেন্দ্রীকৃত সিদ্ধান্ত বা ডিসেন্ট্রালাইজড ডিসিসন: এই পদ্ধতিটিকে অহেতুক হস্তক্ষেপে ভারাক্রান্ত না করা ও বিকেন্দ্রীকরণভাবে পদ্ধতিটিকে কাজ করতে দেয়া।
আমরা শিল্প বিপ্লবের স্তরগুলো সম্পর্কে যে ধারনা পেলাম তাতে বোঝা যায় যে প্রথমটি ছিলো যন্ত্র, পানি, বিদ্যুৎ এর শক্তিতে পরিচালিত। দ্বিতীয়টিকে বলা হচ্ছে গণ উৎপাদন ব্যবস্থা।। তৃতীয়টিকে কম্পিউটার বা স্বয়ক্রিয়তা হিসেবে এবং চতুর্থটিকে সাইবার ফিজিক্যাল বা ডিজিটাল- মানবিক যুগ বলা হচ্ছে।
সোসাইটী ৫.০: জার্মানরা যখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে তাদের তত্ত্ব উপস্থাপন করা শুরু তার বহুদিন পরে জাপান বিবেচনা করতে থাকে যে মানব সভ্যতা পছ্হম যুগে পৌছাচ্ছে। তারা মানব সভ্যতার শিকারী যুগ, কৃষি যুগ, শিল্প যুগ, তথ্যযুগ বলার পর সুপার স্মার্ট যুগ হিসেবে সোসাইটিী ৫.০ কে চিহ্নিত করেছে। জাপানের এই ধারনাটি যতোটা সারা দুনিয়ার জন্য না তার চাইতে বেশি জাপানের মতো বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীসমৃদ্ধ দেশসমূহের জন্য। আমাদের কথা বিবেচনা করলে তাদের ভাবনাটি আমাদের বিপরীত। কারণ আমাদের জনসংখ্যার শতকরা ৬৫ ভাগ তরুণ। তবুও জাপানের পঞ্চম সমাজের ছোট্ট একটা বিবরণ এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। জাপানের বর্তমান জনসংখ্যার ২৬.৩ ভাগের বয়স ৬৫ বছরের ওপরে। তারা মনে করে ২০৫০ সালে বিশ্বের শতকরা ২০ ভাগ মানুষের বয়স ষাটের ওপরে থাকবে। তবে তারা অবশ্য এই কথাটিও বলছে যে ৫.০ সমাজ কেবল বুড়োদের জন্য নয়-সামগ্রিক বিবেচনায় সকলের জন্যই।
দেখা যাক সমাজ ৫.০ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য কি? শুরুতেই বলা হচ্ছে সমাজ ৫.০ এর জন্য পাচটি দেয়াল ভাঙতে হবে। ক) প্রথমেই তারা মনে করে যে প্রশাসন, মন্ত্রণালয় ও সরকারি অফিস সংস্থা জনগনের সাথে যে দেয়াল তুলে রেখেছে সেটি ভাঙতে হবে। আমি খুব সহজেই এটি অনুভব করি যে একটি ডিজিটাল সরকার বিষয়ে আমাদের যে ভাবনা এই দেয়াল ভাঙাটা তার চাইতে বড় কিছু নয়। খ) জাপানের পঞ্চম সমাজের দ্বিতীয় সমাজটা হলো আইনের দেয়াল ভাঙ্গা। গ) সমাজ ৫.০ এর তৃতীয় দেয়ালটা হলো প্রযুক্তিরে দেয়াল। নতুন নতুন প্রযুক্তির সাথে জনগণকে সম্পৃক্ত করা ও সমাজের বিবর্তনে একে কাজে লাগানো হচ্ছে এই দেয়ালটা ভাঙ্গা। ৪) মানবস সম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক দেয়ালটা চতুর্থ দেয়াল। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার সময় থেকেই এই দেয়াল ভাঙার কাজ করছি। ৫) পঞ্চম দেয়ালটি হচ্ছে পঞ্চম সমাজকে সমাজের সকল মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করা।
আমাকে যদি ডিজিটাল শিল্প বিপ্লব ৪.০ বা সমাজ ৫.০ সম্পর্কে মতামত দিতে বলা হয় তবে সবিনয়ে আমরা এটি জানাতে চাই যে ১২ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোণা করে আমরা সারা দুনিয়ার কাছেই একটি সার্বজনীন ঘোষণা প্রকাশ করেছি। কেউ যদি আমার লেখা ২০০৭ সালের ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা ও তার পরবর্তী নিবন্ধগুলো পাঠ করেন তবে এটি উপলব্ধি করবেন যে আমাদের আর যাই থাকুক চিন্তার দৈন্যদশা নেই। বরং আমরা সারা বিশ্বের কাছে ডিজিটাল রূপান্তরের ইশতেহারও ঘোষণা করেছি।
২০০৯ সালের তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালায় আমরা আমাদের কর্মসূচিকে ডিজিটাল বাংলাদেশ বলে সনাক্ত করতে পারিনি। কিন্তু ২০১৮ সালে আমরা সারা দুনিয়াকে ডিজিটাল রূপান্তরের স্বরূপ রচনা করে দিচ্ছি। আমাদের মতো দেশগুলো আমা;দের কর্মসূচিকে তাদের মতো হুবহু অনুকরণ করতে পারে। ব্রিটেন বা জার্মানি যেমন করে আংশিক ডিজিটাল রূপান্তরের কথা বলছে আমরা তার চাইতে বহু পথ সামনে রয়েছে। জাপানও বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নিতে পারে।