প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা এখন চক্রাকার

0
251

সাজ্জাদ আলম খান: চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই এগিয়ে যায় অর্থনীতি। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বছরের পর বছর জমে থাকা নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা এখন চক্রাকারে ঘুরছে। উত্তরণে নেই মনোযোগ। আর নির্বাচনী বছরে এসব চ্যালেঞ্জ আরও জেঁকে বসছে।

উন্নয়ন প্রকল্পের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে প্রতি বছর। কিন্তু সরকারের যে দফতরটি এসব বিষয় দেখে থাকে, তারা শুধু সুপারিশ দেয়ার এখতিয়ার রাখে, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে না। দন্ত ও নখবিহীন আইএমইডি নামে পরিচিত সরকারের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ মাঝে মাঝে সংকট উত্তরণের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে। কিন্তু তা বাস্তবায়নের হাল কে ধরবে?

সংস্কার ছাড়াই কাগুজে হিসাবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি, এডিপি বাস্তবায়নের হার কিন্তু কম নয়। বিদায়ী অর্থবছরে বাস্তবায়ন হয়েছে ৯৪ শতাংশ। ব্যয় হয়েছে এক লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে এটা একটা মাইলফলক। যদিও অর্থবছরের শুরুতে অর্থব্যয় হয় খুবই কম। মোট বরাদ্দের অর্ধেকেরও বেশি অর্থব্যয় হতে দেখা যায় একেবারে শেষের দিকে।

সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে মোট অর্থব্যয় হয়েছে ৯৯ হাজার কোটি টাকার। আর শুধু জুনেই ব্যয় হয়েছে ৪৮ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। তাড়াহুড়ো করা অর্থব্যয়ের মাধ্যমে একটা তৃপ্তির ঢেকুর তোলা গেছে। কিন্তু তা কি গুণগত ব্যয়ের নিশ্চয়তা দিতে পারে? কাজের মান নয়, অর্থ ছাড় ও ব্যয়ই প্রাধান্য পাচ্ছে।

সরকারের মেয়াদ শেষ দিকে। সরকারের ব্যাখ্যা অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার তৎপরতা শুরু করবে সহসাই। তখন শুধু রুটিন কাজ করবে। ভোটারতুষ্টি প্রকল্পগুলোতে তার আগে অর্থ ছাড় নিশ্চিত করতে চাইবে সরকার। কারণ নির্বাচনকালীন সরকারের সময়ে প্রকল্প উদ্বোধন নতুন বিতর্ক তৈরি করতে পারে। সে জন্য আগেভাগেই এসব প্রকল্প নিয়ে ভাবছে সরকার। নির্বাচন তাড়িয়ে ফেরায় হয়তো প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারবে, কিন্তু ওয়াচডগের অভাবে তার গুণগত ব্যয় আরও বড় প্রশ্নের জবাব দেবে।

প্রকল্প নেয়ার আগে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রায়ই করা হয় না। যে কারণে বছর না ঘুরতে একনেক সভায় প্রকল্প ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব আসে। অনেক সময় পর্যালোচনা ছাড়াই অনুমোদন পেয়ে থাকে। দেখা যায়, প্রকল্পের লজিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক যথাযথ হয়নি, নেই সার্বক্ষণিক তদারকি ব্যবস্থা। অনেক ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ ও অনাগ্রহী প্রকল্প পরিচালকও প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি কমিয়ে ফেলে।

ভূমি অধিগ্রহণে পদ্ধতিগত দীর্ঘসূত্রতা দূর করাই যেন যাচ্ছে না। প্রকল্পের বছরভিত্তিক অডিটের বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থাকছে। এসব কারণে তড়িঘড়ি অর্থ ব্যয় করতে গিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি ও মানহীন বাস্তবায়ন হয়ে থাকে। এডিপি বাস্তবায়নে গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, এখনও এসব বিষয়ে ব্যাপক দুর্বলতা রয়েছে। অর্থ বরাদ্দ পেলেও মন্ত্রণালয়গুলো জুলাই মাস থেকে কাজ শুরু করবে, তার প্রস্তুতি রাখে না। আর বর্ষা মৌসুমের কারণেও অনেক সময় প্রকল্প পরিচালকরা মনে করেন, শুষ্ক মৌসুমে কাজ শুরু করা যেতে পারে। নির্বাচনী বছরে এডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮১ হাজার কোটি টাকা।

সামষ্টিক অর্থনীতিতে আরও বেশ চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অর্থনীতির লাইফ লাইন ব্যাংকিং খাতের অব্যাহত সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে। ঋণের সুদ হার কমিয়ে দেয়ার নামে ব্যাংক উদ্যোক্তারা সরকারের সঙ্গে নানা ধরনের দরকষাকষি করছে। আমানতের সুদহার কমাতে কমাতে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। যা নিয়ে নতুন ধরনের সংকটের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। অনেকে সঞ্চয়বিমুখ হয়ে পড়তে পারে। অথবা ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের ফাঁদে পা ফেলতে পারেন।

বাজেটের অর্থায়নের টেকসই কর্মকৌশল এবারও অনুপস্থিত। আর নির্বাচনী বছরের টাকা পাচারের আশঙ্কা বেড়েই থাকে। এসব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিতে না পারলে প্রত্যাশিত জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮ শতাংশে পৌঁছানো বেশ কষ্টকর হবে। সংস্কারবিমুখ সরকার ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণে আনতে কোন ধরনের উদ্যোগ নেবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

ব্যাংকিং খাতের সংকট মোকাবেলা করতে হবে। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখা, সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা, ব্যাংকিং খাত সংস্কার করার মতো কাজ নতুন বছরে করতে হবে। কারণ ব্যাংকিং খাতের নৈরাজ্য অর্থনীতিতে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রতি বছর বাড়ছেই। আর অবলোপনের প্রবণতায় সমৃদ্ধ হচ্ছেন ব্যাংকাররা।
রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। এখানে বড় প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। কিন্তু ভোটার তুষ্ট রাখতে খুব বেশি করের চাপ বাড়েনি। রাজস্ব আহরণ সরকারের পক্ষে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। রাজস্ব আয় কীভাবে আসবে তার সঠিক কর্মপরিকল্পনা অস্পষ্ট। নির্বাচনের আগেই মূল্যস্ফীতির চাপের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, ধাতব পদার্থ ও কৃষি পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী বিরাজ করছে।

প্রতিবেশী দেশ চীন ও ভারতসহ বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে বন্যাজনিত ফসলহানির কারণে আঘাত আসে খাদ্যমূল্যে। ফলে সার্বিক পরিস্থিতি বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে মূল্যস্ফীতির ওপর। যে কারণে গেল অর্থবছরের শুরুতে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করলেও সেখানে থাকতে পারেনি সরকার। নতুন অর্থবছরেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ‘নির্বাচনকেন্দ্রিক’ প্রকল্প বাস্তবায়নের তাড়া থাকবে সরকারের। এতে বাজারে বাড়বে অর্থের জোগান। এ সময়ে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকলেও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বাড়বে। হাওরে আকস্মিক বন্যায় গত বছরের বোরো মৌসুমে যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। চলতি মৌসুমে বোরোর বাম্পার ফলন হলেও আশানুরূপ কমেনি চালের দাম। আবার চাল আমদানিতে যে শুল্ক কমানো হয়েছিল, নতুন অর্থবছরে তা নেয়া হয়েছে আগের অবস্থায়।

ডলারের বিপরীতে টাকা অনেকটা অবমূল্যায়িত হয়েছে, ভবিষ্যতে আরও হতে পারে। এতে আমদানি ব্যয় আরও বাড়বে। সরকার বড় বাজেট বাস্তবায়ন করছে, বাড়তি আমদানির কারণে মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে হচ্ছে, ফলে মুদ্রা সরবরাহজনিত কারণেও এক ধরনের মূল্যস্ফীতি হতে পারে। আশঙ্কাটা হচ্ছে, সামনে নির্বাচনের সময়ে লেনদেনের চাপ বেড়ে যেতে পারে।

নতুন বাজেটে অনেক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যার বেশিরভাগই অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হবে। সব মিলিয়ে টাকা-পয়সার লেনদেন বাড়লে মূল্যস্ফীতির ওপর একটি চাপ পড়ে এবং তা বাড়ার প্রবণতা থাকে। আগামী ছয় মাস কিভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তা নিয়েই ভাবতে হবে। নির্বাচনী ব্যয় বাড়লে তখন সরকারি ব্যয়ও বাড়বে। মানুষের চাহিদা ও ভোগ বাড়বে, সামগ্রিক চাহিদা বেড়ে যাবে। তখন জোগান যদি সে পরিমাণে বাড়ানো না যায়, তাহলে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে।

বিদেশের সঙ্গে লেনদেনে বড় ঘাটতিও অর্থনীতিকে চাপে ফেলেছে। জ্বালানি তেলের দাম ইতিমধ্যে অনেক বেড়ে গেছে এবং উৎপাদনকারী দেশগুলোর নানা সিদ্ধান্ত ও অন্যান্য ভূ-রাজনৈতিক কারণে আরও বাড়তে পারে এমন পূর্বাভাস রয়েছে। রফতানির তুলনায় আমদানি বৃদ্ধির হার অনেক বেশি থাকার কারণ বহির্বিশ্বের সঙ্গে লেনদেনে ঘাটতি বেড়ে যাওয়া। বড় ঘাটতি ইতিমধ্যে অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করেছে। এ চাপ আরও বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ রয়েছে।

বাণিজ্য ঘাটতি ১০ মাসে হয়েছে ১৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা আগের একই সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ। চলতি হিসাবে ঘাটতি বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার। আগে কোনো একটি পূর্ণাঙ্গ অর্থবছরেও এত ঘাটতি হয়নি। ব্যাংকের মতো শেয়ারবাজারও বছরজুড়ে নানা আলোচনার জন্ম দেয়।

২০১৭ সালে শেয়ারবাজার আগের বছরের চেয়ে তুলনামূলক ভালো গেছে। এ বছরের প্রথম ৬ মাসে এ বাজারে অনেক অস্থিশীলতা দেখা গেছে। সূচকের বেশ পতন হয়েছে। প্রায়ই টানা দরপতন ঘটছে। সর্বোপরি জাতীয় নির্বাচন একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে না। কিন্তু এর অন্যথা হলে বিরূপ প্রভাব পড়বে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে স্থিতিশীল পরিবেশ না থাকলে অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়বে। বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হবে।

সাজ্জাদ আলম খান : অর্থনীতি বিশ্লেষক
sirajgonjbd@gmail.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here