হাফিজুর রহমান: এমন কোন বিখ্যাত মানুষ আমি নই যার স্মৃতিকথা না থাকলে পৃথিবী রসাতলে যাবে। তবু যে লিখছি, তার কারণ বোধকরি দ্রুত-চলমান সময়। বিংশ-শতাব্দীর মধ্যকাল থেকে এখন পর্যন্ত যে জটিল-ঋজু-কঠিন আবার উপভোগ্য অভিজ্ঞতা বুকে নিয়ে এগিয়েছি, তার কিছুটা পাঠকের কাছে তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই এই প্রয়াস।
৫.
সকলের ছেলেবেলা-জুড়ে খেলাধুলার বিশাল এক স্মৃতি-ভান্ডার থাকে। আমারও রয়েছে। কিন্তু তা মোটেই সুখকর নয়, সমৃদ্ধ তো নয়ই। কেন যেন খেলাধুলার বিষয়টি আমাকে বুঝিয়ে দিতে তৎপর ছিল যে, ওই জায়গাটা কোনদিন আমার জন্যে সচ্ছন্দের হবে না। সব খেলাই খেলেছি। অন্তত: চেষ্টা করেছি। কিন্তু খেলার আনন্দে খেলতে পারিনি।
আব্বা নাকি খুব ভালো ফুটবলার ছিলেন। সেজো-চাচা এবং অন্য চাচারাও। তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় হায়ারেও খেলতে যেতেন। একবার নাকি কোন এক টুর্ণামেন্টে আব্বাকে খেলতে নেওয়া হয়েছিল। সেজো-চাচাকে ডাকেনি তারা। তাঁর আত্ম-মর্যাদায় আঘাত লাগায় যেচে গিয়ে বিপক্ষ-দলের হয়ে খেলেছিলেন, এবং জয়ী হয়ে বাড়ি ফিরে খাশি জবাই করে উৎসব করেছিলেন। কিন্তু একারণে দুজনের মধ্যে কোন মনো-মালিন্য হয়নি।
সেই বাড়ির সন্তান হয়ে খেলাধুলার প্রতি আমার আবাল্য নিরুৎসাহ আব্বাকে হয়তো করতো। তিনি চাইতেন,খেলাধুলার প্রতি আমি যেন আগ্রহী হয়ে উঠি। কিন্তু আমি তো বুঝতাম, ওটা আমার হবেনা কোনদিনও। ছোট্ট-বেলায় মার্বেল-গুলি খেলেছি, ডাংগুলি, হা-ডুডু, ফুটবল–সবই খেলে দেখেছি, শরীর আর মগজ এক হয়ে আমাকে সফল ও সক্রিয় করতে চায়নি কখনো।
ক্রিকেট তখনো আম-জনতার কাতারে নামেনি। তবে ট্রানজিস্টার-রেডিওর কল্যাণে শিক্ষিত-জনের বিনোদনের যোগ্য মাধ্যম হয়ে উঠছে ক্রমশ:। আমাদের পাড়ায় ছোট্ট মাঠে হাতে বানানো ব্যাট ও বল দিয়ে খেলতাম আমরা। আমার সহপাঠী-বন্ধু-কাম-চাচা কচি ছিল এই দলের সর্দার। বাবলা-গাছের মোটা ডাল দিয়ে ব্যাট ও বল বানাতে ওস্তাদ। খেলতে উত্সাহী হয়েও অজানা কোন এক আতঙ্ক ও অস্বস্তিতে ভুগেছি সর্বক্ষণ। সারাদিন ফিল্ডিং-এর খাটুনির পর ব্যাট হাতে নেমে বোলারের ছোড়া বল দেখেই চোখ বন্ধ হয়ে যেত যেন।
ডুমুরিয়া যুব-সঙ্ঘ তখন দারুণ সক্রিয় সংগঠন। যুব-সঙ্ঘ মাঠে কাকা-কাক্কুদের সাথে খেলতে নেমেও সকলের অলক্ষ্যে একই অস্বস্তির পীড়নে জর্জরিত হয়েছি। বুঝেছি, এ আমার কাজ নয় আদৌ। খেলার কমেন্ট্রি শোনার আনন্দের সাথে বলের মুখামুখি হয়ে ব্যাট চালানোর পার্থক্য বিস্তর। এভাবেই খেলার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম একসময়ে।
তখন ট্রানজিস্টারে কলকাতা ও ঢাকা কেন্দ্রে কলকাতার নামী শিল্পীদের আধুনিক-গানের অনুরোধের আসর দারুণ আকর্ষণীয় ছিল।
ট্রানজিস্টার কেবল এসেছে গ্রামগঞ্জে। আব্বা তখন চেয়ারম্যান থাকায় কাউন্সিল অফিসের সেটটা কিছুদিন আমাদের বাড়িতেই থাকতো। নীতির কাছে সাংঘাতিক দায়বদ্ধ আমার আব্বা কাউন্সিলের সেটটা অফিসেই ফিরিয়ে দিলে আম্মার পীড়াপিড়িতে প্রায় সাত-মাইল পায়ে হেঁটে সাড়ে সাতশো টাকায় একটা পুরনো সেট কিনে আনতে হয়েছিল আমাকেই। সেটাই ছিল আমাদের অলস দুপুরের গান-শোনার যন্ত্র, অসাধারণ সব শ্রুতি-নাটকের নিবিষ্ট শ্রোতা হতে পারার একমাত্র অবলম্বন। তখনই বুঝে নিয়েছিলাম, শারীরিক কসরত নয়, হৃদয়বৃত্তির কারুকর্মে আমার আগ্রহ ও অধিকার কিছুটা হলেও সহজাত।
সেসময়ে বর্ষাকাল এলে স্কুলগুলোর মধ্যে ফুটবলের জোনাল-খেলা হতো। তখন জানতাম, জুন-জুলাইতে খেলা হতো বলেই সেটা জোনাল-খেলা ছিল। বোকা আমি, বেশ দেরিতে বুঝেছিলাম, জোন ভাগ করে খেলার আয়োজনের জন্যেই খেলার নাম জোনাল-খেলা। ডুমুরিয়া স্কুলের মাঠে এই খেলার সময়ে গ্রাম ভেঙে হুমড়ি খেয়ে পড়তো স্কুলমাঠে। বয়ারভাঙ্গা স্কুল-দলের খুব নামডাক ছিল এই টুর্ণামেন্টে। কী অবাক কাণ্ড, ওদের খেলার দিনে বৃষ্টি যেন অঝোরধারায় ঝরতো। বৃষ্টি-কাদার টইটুম্বুর মাঠে দাপিয়ে খেলতে ওদের ছেলেদের জুড়ি ছিল না। আমি দেখতাম আর বিষ্মিত হয়ে উঠতাম ওদের শারীরিক সামর্থ ও কৌশলগত নৈপুণ্যে।
খুলনায় পড়াকালেও দর্শকের ভূমিকাটি সচল রেখেছিলাম কিছুদিন। একদিন শুনলাম, জেলাস্কুল-মাঠে ডুমুরিয়ার সাথে ফাইনাল খেলবে বেলফুলিয়া। যে আগ্রহ নিয়ে গিয়েছিলাম, তার চতুর্গুণ বিরক্তি ও বিবমিসা নিয়ে ফিরেছিলাম সন্ধ্যায়। ডুমুরিয়া জিতছিল যখন, হঠাৎ শুরু হলো গন্ডগোল। সে কী মারপিট ! আমি একতলা দালানের ছাদে বসে খেলা দেখছিলাম। বাঁচার তাগিদে লোহার সিড়ি দিয়ে নামতে কয়েকবারই ব্যর্থ হলাম। অগত্যা উদভ্রান্তের মতো সেই পুরনোদিনের উঁচু ছাদ থেকে লাফ দিয়ে সেই যে মাঠ ছেড়েছি, আর কোনদিন ওমুখো হইনি। বড়ো হয়ে কিছুদিন খুলনা মুসলিম ক্লাব ( বর্তমান মোহামেডান ক্লাব ) এর কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনকালেও কেউ আমাকে মাঠমুখো করতে পারেনি। আমি বুঝেই নিয়েছিলাম, শারীরিক দক্ষতার পথে নয় মোটেই, আমার সচ্ছন্দ বিচরণ-ক্ষেত্র মনন-নির্ভর কর্মকাণ্ডেই। (চলবে…)