সাজ্জাদ আলম খান: কর্পোরেট পুঁজির করাল গ্রাসে পড়েছে শ্রম অধিকার। ন্যায্য মজুরি নির্ধারণের বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত রয়ে যাচ্ছে। আর এর পাশাপাশি রয়েছে কাজ হারানোর শঙ্কা, কর্মক্ষেত্রে অস্থিরতা, অনিরাপদ কর্ম পরিবেশ। শ্রমিকবান্ধব সাংগঠনিক কাঠামোর অভাবে দাবি-দাওয়া আদায়ে পারদর্শিতার পরিচয় মিলছে না। নৈরাজ্য সৃষ্টির অভিযোগ এনে ত্যাগী সংগঠকরা পুরনো কায়দায় লাঞ্ছিত, নিগৃহীত হচ্ছেন। চাকরিচ্যুতি তো আছেই। আর এরই মাঝে, প্রভাব বলয় বিস্তার করে, শ্রম আইন থেকে বের হয়ে যেতে চায় ব্যাংকিং খাত। বেড়ে যাচ্ছে আউট সোর্সিং।
এই প্রক্রিয়াতে সেবাদাতা ও গ্রহীতারা বেশ খুশি। কিন্তু এর মাঝে ভেঙে যাচ্ছে কর্ম পরিবেশের নিরাপত্তা। অল্প অর্থে কাজ করাতে তাই করপোরেট বসরা বিশ্বের বিভিন্ন দিগন্তে বসে থাকা বিষয়ভিত্তিক দক্ষদের কাছে কাজ পাঠিয়ে থাকেন। কাজ শেষে আবার পারিশ্রমিক পরিশোধ করে থাকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। অল্প অর্থে কাজ করাতে চাইলেও, এসব প্রতিষ্ঠান শ্রমের অবাধ যাতায়াত আবার চায় না।
ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম নিয়ে নানা প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। অভিযোগ আছে শ্রমিক নেতাদের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তার। এর পাশাপাশি আরো একটি বিষয় ভাবিয়ে তুলেছে মালিকবান্ধব ট্রেড ইউনিয়ন তৈরির। অর্থাৎ শ্রমিকের স্বার্থ নয়, মালিক ইচ্ছা এখানে প্রাধান্য পাবে। বিভিন্ন খাতে এ ধরনের প্রবণতা বাড়ছে। আর দুর্বল আর্থিক কাঠামোর কারণে প্রতিকার পেতে সংকটে পড়ছে শ্রমিক সমাজ। মামলা করেও অনেক সময় প্রতিকার পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়ন করার দায়ে ১৯৯৭ সালে রাজধানীর এক পোশাক শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়।
প্রতিকার পেতে শ্রম আদালতে মামলা করলেও, ২০০৬ সালে তাকে চাকরিতে বহালের পক্ষে রায় দেয় আদালত। এই রায় কার্যকর করতে আবার তাকে মামলা করতে হয়। অবশেষে ২০০৯ সালে মালিকের ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ দিয়ে রায় দেয় শ্রম আদালত। সব মিলিয়ে মামলা নিষ্পত্তিতে লেগেছে ১৩ বছরেরও বেশি সময়। শ্রম আইনে মামলা করে বছরের পর বছর অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয় অনগ্রসর শ্রমিকদের।
শ্রমিকের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে, কিন্তু সে অনুপাতে বাড়েনি সংশ্লিষ্ট আদালতের সংখ্যা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী ছাড়া অন্য কোনো জেলায় শ্রম আদালত নেই। একমাত্র শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল ঢাকায়। ১৯৭২ সালে ছয়টি শ্রম আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ঢাকায় তিনটি এবং চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে তিনটি আদালত স্থাপিত হয়। ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রামে আদালতের সংখ্যা একটি বেড়ে মোট হয় সাতটি। ওই সময়ে দেশে শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১০ লাখ। দেশে ৬ কোটি ৮০ লাখ মানুষ কাজে নিয়োজিত আছে। যেসব জেলায় শ্রম আদালত নেই, সেখানকার শ্রমিকদের প্রতিকার পেতে যেতে হয় সংশ্লিষ্ট আদালতে। এজন্যে তার বাড়তি টাকা খরচ করতে হয়।
বাংলাদেশে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি এবং শিল্পভিত্তিক ন্যূনতম মজুরি রয়েছে। ন্যূনতম মাসিক মজুরি দৈনিক এবং সাপ্তাহিক কাজের ঘণ্টার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে যা হলো ৮ ঘণ্টা দৈনিক এবং ৪০ ঘণ্টা প্রতি সপ্তাহ। শ্রম আইন ২০০৬ অনুসারে, মাসিক ন্যূনতম মজুরি প্রতি সপ্তাহে কাজের ঘণ্টার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়। ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করার পেছনে জীবনযাত্রার খরচ, শ্রমিকের এবং তার পরিবারের চাহিদা, উৎপাদনের খরচ, উৎপাদনশীলতা, পণ্যের দাম, ভোক্তা মূল্য দিতে নিয়োগকারীদের ক্ষমতা, দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা, মুদ্রাস্ফীতির হার ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে থাকে।
ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি ও পরিবর্তনের হার যৌথভাবে সরকার, নিয়োগকর্তা এবং ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধিদের দ্বারা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা হয়, পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয় না। এ পর্যন্ত ৪২টি পেশায় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হলেও কোনো খাতেই শতভাগ বাস্তবায়ন হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্ধারিত মজুরিও অত্যন্ত কম। এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৮ শিল্পে মজুরি ঘোষণাই করা হয়নি। প্রতি পাঁচ বছরের মধ্যে মজুরি পর্যালোচনার নিয়ম থাকলেও তা হয় না বেশিরভাগ শিল্পে।
মজুরির অবস্থা তো বেশ খারাপ। মজুরি বোর্ডের তথ্য বলছে, পেট্রোল পাম্প শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য মাসিক মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে মাত্র ৭৯২ টাকা। মূল মজুরি ধরা হয়েছে ৫৬০ টাকা; বাড়ি ভাড়া ১১২ টাকা ও যাতায়াত বাবদ ২০ টাকা। ১৯৮৭ সালে মজুরি ঘোষণার পর এখন পর্যন্ত তা পর্যালোচনা করা হয়নি। এই যখন অবস্থা, তখন বেসরকারি ব্যাংকিং খাত শ্রম আইনের আওতামুক্ত হতে চায়। আইন অনুযায়ী, বার্ষিক মুনাফার ৫ শতাংশ অর্থ সরকারের শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে জমা দিতেও রাজি নয় তারা। তাদের এই প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইন মন্ত্রণালয়। বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের একটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ উদ্যোগ নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট এবং ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয় শ্রমিক সমাজ; কিন্তু সেই অধিকার আজও পুরোপুরি অধরা। অনেক ক্ষেত্রে যা অর্জন হয়েছিল, তাও ধরে রাখা যাচ্ছে না। নিরাপদ নেই শ্রমিক, গেল বছর কর্মক্ষেত্রে নিহত হয়েছে ৭৮৪ জন শ্রমিক। পরিবহন খাতে নিহতের সংখ্যা ৩০৭ জন। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে নির্মাণ খাত, এ খাতে জীবন দিয়েছে মোট ১৩৪ জন শ্রমিক।
এছাড়া রয়েছে নির্মাণ, দিনমজুর, কৃষিসহ আরো ছয়টি খাত। সড়ক দুর্ঘটনা, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট, ওপর থেকে পড়ে যাওয়া, অগ্নিকাণ্ড এবং মাটিচাপায় জীবন হারান শ্রমিক। গবেষণা সংস্থা বিলসের তথ্য বলছে, পাঁচ বছরে কর্মক্ষেত্রে নিহত হয়েছেন চার হাজার ১৫৫ জন শ্রমিক। আর আহতের সংখ্যা সাত হাজার। খাতভিত্তিক আন্দোলন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে ৫৯ শতাংশ আন্দোলন হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্পে। ২৩ শতাংশ আন্দোলন হয়েছে কৃষিতে।
বিলস বলছে, বকেয়া মজুরির জন্য আন্দোলন হচ্ছে চল্লিশ ভাগ। অর্থাৎ কাজ শেষে প্রতিশ্রুত মজুরি ও ভাতা পরিশোধে রয়েছে গড়িমসি। মুনাফামুখী প্রবণতা আর উদ্বৃত্ত মূল্য হাতিয়ে নিতে তৈরি করা হয় এক ধরনের পরিবেশ। আর অন্যান্য দাবি বা অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন হচ্ছে। কিন্তু তার পরিমাণ ২৫ ভাগ। এরপরে রয়েছে বন্ধ কারখানা চালু আর পাওনা পরিশোধের জন্য। সঙ্গীন অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে বাংলাদেশের বেশিরভাগ শ্রমিক এখন অনেকটা সামাজিক কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ঐতিহাসিক তত্ত্ব অনুসারে, শ্রমিক তার উৎপাদিত পণ্য থেকে পৃথক হয়ে যায়। একজন নির্মাণ শ্রমিক বড় ধরনের বাসা-বাড়ি বা ফ্ল্যাট তৈরি করলেও তাতে থাকার সামার্থ্য থাকে না।
অর্থাৎ তার উৎপাদিত পণ্য থেকে পৃথক হয়ে যায়। উৎপাদন উপকরণের ওপর কর্তৃত্ব না থাকায়, এ ধরনের অবস্থা তৈরি হয়। একজন মানুষ অপরজন ও প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পুঁজিবাদে শ্রম বিক্রির স্বাধীনতা ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে যায়। মানুষ ক্রমান্বয়ে নিজ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে; অনেকটা মেশিনের অনুরূপ হতে থাকে। কার্ল মার্কস তার বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বে উল্লেখ করেন, এই বিযুক্তিতে শ্রমিক মানবীয় সত্তা হারিয়ে ফেলে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, ২০১৬ সালে দেশের মানুষের মোট আয়ের ০.২৩ শতাংশ আসে সবচেয়ে দরিদ্রদের পাঁচ ভাগ থেকে। যা ২০১০ সালে ছিল ০.৭৪ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৬ সালে মোট আয়ে সবচেয়ে ধনী পাঁচ শতাংশের অবদান ২৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আর ২০১০ সালে ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ ছিল। সবচেয়ে দরিদ্র পাঁচ শতাংশের খানা প্রতি আয় ২০০৫ সালে ছিল ১১০৯ টাকা, যা কমে ২০১৬ সালে ৭৩৩ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০১৬ সময়ে দেশে আয়বৈষম্য পরিমাপক জিনি অনুপাত বেড়ে হয়েছে ০.৪৮।
অনুপাত যত কম, বৈষম্যও তত কম। এই অনুপাত ০.৫ মানেই হলো এটা অতি উচ্চ বৈষম্যের দেশ। আমরা এটার খুব কাছাকাছি।