হাফিজুর রহমান: এমন কোন বিখ্যাত মানুষ আমি নই যার স্মৃতিকথা না থাকলে পৃথিবী রসাতলে যাবে। তবু যে লিখছি, তার কারণ বোধকরি দ্রুত-চলমান সময়। বিংশ-শতাব্দীর মধ্যকাল থেকে এখন পর্যন্ত যে জটিল-ঋজু-কঠিন আবার উপভোগ্য অভিজ্ঞতা বুকে নিয়ে এগিয়েছি, তার কিছুটা পাঠকের কাছে তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই এই প্রয়াস।
৮.
যখন ক্লাস এইটে পড়ি, তখন দেশে নতুন ঘটনা ঘটলো। যুদ্ধ । পয়ষট্টির ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ । রাজনীতি বোঝার বয়স হয়নি তখনো। তবু রাজনীতির ঘটনা-দুর্ঘটনা তো বালক বলে রেহাই দেয়না। হঠাৎ শুনলাম, পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যে কোন সময়ে আমরাও আক্রান্ত হতে পারি। স্কুল থেকে বাজার পর্যন্ত কেমন সন্ত্রস্ত সবাই। কেমন একটা যুদ্ধময় সাজসাজ পরিবেশ সর্বত্র।
আমাদের ভাড়ার বাসার সামনেই একটা বাড়িতে থাকতেন তৎকালিন পিআইএ,খুলনা-অফিসের ম্যানেজার খানসাহেব। কমার্স কলেজের নাইট-সেকশনে পড়তেনও। বিকেলে অফিস থেকে ফিরে আমাকে বললেন, তুমি বাড়ি চলে যাও হাফিজ।
আমার বাসার স্যার চলে গিয়েছিলেন আগেই। কাকাও বাসায় ছিলেন না। আগের রাতে সারা শহরের বাতি নিভিয়ে দিলে লালিকে নিয়ে বিভীষিকাময় রাত কাটিয়েছিলাম। আজ আর সাহসে কুলালো না। কিন্তু যাবো কীভাবে ! মনে পড়লো গয়নার নৌকার কথা। বড়ো-ধরনের এই নৌকাগুলি প্রতি সন্ধ্যায় ডুমুরিয়া ও খুলনা থেকে একই সময়ে ছেড়ে আসতো। বাজারের মালামাল ও যাত্রী–দুইই আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা ছিলো তাদের।
বিকেলবেলায় বড়োবাজারের গয়নাঘাটে গিয়ে পরিচিত হানিফ-চাচাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে যেন প্রত্যাশিত প্রস্তাব শুনে সানন্দে বললেন, শিগগির উইঠা বইসো বাপজান। অহনি নাও ছাড়ুম।
সেদিন ছিলো জ্যোৎস্নারাত। ভরা জোয়ারে পাল তুলে নদীজলে ভাসার অভিজ্ঞতা সেই প্রথম। ভয় তো নয়ই, বরং অসাধারণ এক ভালোলাগার অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম। কোথায় ব্লাক-আউট, কোথায় যুদ্ধের আতঙ্ক–মনে হলো, জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলিকে স্পর্শ করে এগুচ্ছিলাম। রাতে চাচারাই ওদের রান্না খাওয়ালেন পরমযত্নে। জ্যোৎস্নালোকের মায়াবী আলোয় বসে সেই রাত্রির মুখরোচক খাবারের স্মৃতিময় আস্বাদ আজও ভুলতে পারিনি।
সতেরো দিনের মতো যুদ্ধছুটির পরে খুলনায় ফিরে বুঝলাম যুদ্ধভীতি সরে গিয়ে মানুষের মনে যেন ক্রমশ: সত্যদৃষ্টির জন্ম হচ্ছে। গ্রামে তো বটেই, শহরের মানুষও ঘটে যাওয়া যুদ্ধ-নাটকের অন্তসার-শূন্যতা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। পূর্ববাংলায় একটা যুদ্ধ-বিমানও আসেনি, কিন্তু যদি সত্যিই আসতো–তাহলে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সন্তোষজনক কোন কেন্দ্রীয় উদ্যোগ ছিলো না একেবারেই। এটা যে বুমেরাং হয়ে দেশের মানুষকেই দ্রুত বাঙালিত্বের বোধে উজ্জীবিত হতে এগিয়ে এনেছিলো, তা আমার মতো ক্লাস এইটের বালকের কাছেও অস্পষ্ট থাকেনি। আমাদের অনুমানের ফল ফলতেও তাই দেরি হয়নি খুব।
এইট-এ পড়াকালে বড্ড ছোট ছিলাম। হাফ-প্যান্ট পরে হামেশাই সর্বস্থানে ছুটতাম। নাইন-এ উঠে তা আর হলো না। কেমন যেন হুহু করে বেড়ে উঠলাম। দেখি দৈর্ঘে আমি সবাইকে ছাড়িয়ে উঠতে চলেছি। মনটা তখনো তেমন প্রস্তুত হয়নি। কানে শুনে কোনো কথা মগজ পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সময় লাগতো। তবু ভাবনাটা ভাবতে পারছি তো।
ষাট-দশকের শেষদিকে বাঙালিও নতুন ভাবনা ভাবতে শুরু করলো। ছয়-দফা এলো, দাবীর স্বপক্ষে দেশব্যাপী মানুষকে জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টা চলতে থাকলো। আমি তখন নাইন-টেন এর কঠিন মানবিক চর্চায় ডুবে রয়েছি। সকল বিষয়ের সাথে একটা সম্মানজনক বোঝাপড়া হলেও অঙ্ক-বিষয়টি কখনো ধরা দেয়নি আমার কাছে। সকালে যে যে অঙ্ক-কষার মশকো করে পরীক্ষার হলে গিয়েছি, হলে বসে সেগুলো নিয়েই তালগোল পাকিয়ে হয়রান হয়েছি। এসএসসি’র প্রাক-নির্বাচনী ও নির্বাচনী পরীক্ষায় যথাক্রমে অঙ্কে পেয়েছিলাম ০১ এবং ৩১।
পরীক্ষার পরই এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছোট-ফুপুর বিয়ে হলো। তাঁর সাথে আমাকেই যেতে হয়েছিলো। মনে আছে, ফেরার পথে উনচল্লিশ-টাকার টিকিটে প্রথম প্লেনে উঠি। তার আগে সেভেন-এ পড়াকালে আব্বার সাথে খুলনা হেলিপ্যাড থেকে হেলিকপ্টারে উড়ে ঢাকায় গিয়েছিলাম। হেলিপ্যাডটা আজো রয়েছে, সার্ভিসটা নেই। অনেককিছুই নেই খুলনার, যা ছিলো ঐতিহ্যের মতো। সবার পূর্বে মনে পড়ে স্টিমার-সার্ভিস অস্ট্রিস ও লেপচা’র কথা। কতো যে স্মৃতিময় ছিলো !
খুলনা চিরকালই বড়ো অবহেলিতই রয়ে গেলো।