সাজ্জাদ আলম খান: চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চার দশক অতিক্রম করেছে। সামনে এসেছে সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক বিরোধিতার মতো বিষয়ও। ক্ষুদ্রঋণের কর্মীদের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও কম নয়।
দু’-এক জায়গা থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ার নজিরও রয়েছে। কিন্তু আধুনিক ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের জন্মস্থানে নতুন এক সংকট দেখা দিয়েছে। এ নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। সেটি হচ্ছে তহবিল জোগানোর উৎসপথে অদৃশ্য বাধা।
অনিচ্ছাকৃত-অপ্রত্যাশিত এ বাধার প্রাচীর তৈরি করেছে ব্যাংকিং খাত; অদক্ষতা আর নানা চাপে পরিচালিত বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সংকট তৈরি হয়েছে। যার খেসারত দিতে হবে তৃণমূলের সাধারণ মানুষকে। যাদের কণ্ঠস্বর সাধারণত নীতিনির্ধারকদের কানে পৌঁছে না।
অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ এখন তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। প্রাতিষ্ঠানিক লেনদেনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত হচ্ছেন প্রতিদিনই কেউ না কেউ। এ রকম অবস্থায় যেন দানবীয় শক্তির অভ্যুদয় ঘটেছে।
ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের সদিচ্ছার অভাব নেই। সহায়ক শক্তি হিসেবে নয়, নিয়ন্ত্রণ আরোপের লক্ষ্যে গঠন করা হয় মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি- এমআরএ। ‘ভাত দেয়ার মুরোদ নেই কিল মারার গোসাই’-এর মতো প্রতিষ্ঠানটি বড় বেশি নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে হালনাগাদ তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করতে পারেনি এমআরএ। দুর্যোগ আর দুর্বিপাক মোকাবেলায় কর্মকৌশল নির্ধারণের জন্য পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ জরুরি- সে বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। সংকট তৈরি হল তিন মাসে। কিন্তু বিশ্লেষণ করতে হচ্ছে পূর্ববর্তী দু’বছরের পরিসংখ্যান। এজন্য শুধু এমআরএকে দোষারোপ করলে চলবে না।
এর দায় এ খাতের সংগঠকদের বহন করতে হবে। পরিসংখ্যান ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও সক্ষমতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
তহবিল সংকটে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম। পূর্বঘোষণা ছাড়া গেল ডিসেম্বর থেকে তহবিল সরবরাহ বন্ধ রেখেছে অনেক ব্যাংক। নিজস্ব মূলধনের পাশাপাশি সদস্যদের সঞ্চয়ই দেশের ক্ষুদ্রঋণের মোট তহবিলের মূল ভিত্তি ও বৃহত্তম উৎস।
২৬ শতাংশ বেড়ে ২০১৬ সালে এ সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি; যা প্রায় সাড়ে ৩৪ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎস হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত আয়, যা মোট তহবিলের সাড়ে ৩৩ শতাংশ। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফও তহবিল জোগান দিয়ে থাকে।
তবে সেখানে যেন টান চলছে। অথচ স্বায়ত্তশাসিত এ প্রতিষ্ঠানটি এখন জোরালো ভূমিকা রাখতে পারত। মোট তহবিলে পিকেএসএফের অবদান ২০১৬ সালের তুলনায় হ্রাস পেয়ে পরের বছর দাঁড়িয়েছে সোয়া আট শতাংশ। তবে বাণিজ্যিক ব্যাংগুলোর অবদান বাড়লেও এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২০১৫ সালে তা ১৭ শতাংশ থেকে উন্নীত হয়ে ২০১৬ সালে হয়েছে ১৯ শতাংশের কিছুটা বেশি।
ব্যাংকিং খাত তাদের প্রচলিত ধারণার বাইরে এসে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থায় বিনিয়োগ শুরু করে প্রায় দেড় দশক আগে। শুরুর দিকে রাজধানীর বাইরের একটি সংস্থাকে বাছাই করেছিল সোনালী ব্যাংক।
তদানীন্তন সময়ের ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাজমিলুর রহমান, অনেকটা সন্দেহ আর সংশয়ের মধ্যে থেকে ঋণ বিতরণ করলে শেষ পর্যন্ত তৃপ্ত হয়েছিলেন, লেনদেন কার্যক্রমে। এরপর সাফল্য পর্যালোচনা করে অনেক ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে অংশীদারিত্বমূলক কর্মূসচি।
পাইকারি অর্থায়নের এ সেবায় যুক্ত হয় বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নামও। এখন যেন তা হঠাৎ করেই থমকে গেছে। ব্যাংকিং খাতের বর্তমান হালহকিকত নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন। ঋণ কেলেঙ্কারি, কর্পোরেট গ্রাহকদের দৌরাত্ম্য, বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের বেনামি ঋণ গ্রহণ, রাজনৈতিক চাপ তো আছেই। এ অবস্থায় ব্যাংকিং খাতের নেতিবাচক প্রভাব এসে পড়েছে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাপনায়।
সময় ও চাহিদামতো গ্রাহককে তহবিল বিতরণ ও সঠিকভাবে তা আদায় করাই ক্ষুদ্রঋণের মূল চালিকাশক্তি। ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ঐকান্তিক চেষ্টা, নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং গ্রাহকের সঙ্গে পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে আদায়ের হার ৯৯ শতাংশের বেশি।
স্থানীয় ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই আর্থিকভাবে খুব বেশি স্থায়িত্বশীল নয়। তাই সদস্য সঞ্চয়, পিকেএসএফ, ব্যাংক ঋণের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বর্তমানে প্রায় সাতশ’ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান তাদের ১২ হাজার শাখা ও দেড় লাখ কর্মীর মাধ্যমে অবহেলিত, দরিদ্র ও ব্যাংকিং সেবা থেকে বঞ্চিত সাড়ে তিন কোটি গ্রাহককে আর্থিক সেবা প্রদান করছে।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে এর পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকার বেশি। ক্ষুদ্রঋণ গ্রাহকের ৯১ ভাগ হচ্ছে নারী। আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের নানাবিধ উদ্যোগের পাশাপাশি ক্ষুদ্রঋণের বিশেষ অবদান রয়েছে।
প্রায় চার দশক ধরে ক্ষুদ্রঋণের সব ধারাবাহিক অগ্রগতির ফলে দেশের জিডিপিতে এর অবদান ৭ শতাংশ। দারিদ্র্যবিমোচনে প্রত্যক্ষ অবদান ১৪ শতাংশ। আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি তৃণমূলে মজুরিভিত্তিক ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে ক্ষুদ্রঋণ খাত।
গত ডিসেম্বরের পর থেকে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আর তহবিল গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে ঘনীভূত হচ্ছে তারল্য সংকট। এমনকি অনুমোদিত তহবিলও ছাড় করা হচ্ছে না। আগের চুক্তি অনুযায়ী পরিশোধ সাপেক্ষে আবার ঋণ প্রদানের কথা থাকলেও তা স্থগিত রয়েছে।
নতুন কোনো প্রস্তাবও আর ব্যাংকগুলো গ্রহণ করছে না। পরিস্থিতি এতই জটিল হয়েছে, দুই অঙ্কের ঘরে সুদ পরিশোধের অঙ্গীকার করেও ঋণ মিলছে না।
ব্যাংক থেকে পূর্বনির্ধারিত ধারা অনুযায়ী ঋণ না পাওয়ায় সংস্থাগুলোর আর্থিক চক্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে আদায়ের হার হ্রাস ও সদস্যদের দলত্যাগ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঋণ পরিশোধের বিপরীতে নতুন ঋণ না পাওয়ায় অনেকেই তাদের জমাকৃত সঞ্চয় তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে, মাঠ পর্যায়ে সদস্যদের সঙ্গে সংস্থার পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাড়ছে অনাদায়ী বকেয়া। মাঠ পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হওয়ার কারণে কর্মী ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ ধারা অব্যাহত থাকলে নির্বাচনের বছরে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। এমনকি শহরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কার্যক্রমেও তার ছাপ পড়বে। নগরের অনেকে অভিজাত বিপণিবিতানে পণ্যের জোগানদাতা ক্ষুদ্রঋণসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।
ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, শহরমুখী স্থানান্তর, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মাঝে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম হ্রাস পাবে। দেখা মিলবে গ্রামীণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা। কৃষি অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। জিডিপিতে এর অংশ ১৪ ভাগ এবং শ্রমবাজারে অবদান ৪৭ ভাগ।
উৎপাদন বৃদ্ধিতে ঋণের পাশাপাশি প্রান্তিক কৃষকের নানা প্রযুক্তিসেবা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করছে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম। এ খাতের তারল্য সংকট চলমান থাকলে তথা ব্যাংক থেকে অর্থায়ন বন্ধ হয়ে গেলে দেশের সামগ্রিক কৃষিখাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ পরিস্থিতিতে বেইল আউট কর্মসূচি নিতে পারে সরকার। দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে বেইল আউট কর্মসূচির আদলে মূলধন সংকট মোকাবেলা করা হচ্ছে। বেইল আউট হচ্ছে মূলধন সংকটে থাকা প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা করা। রাষ্ট্রও অনেক সময় বেইল আউটের মাধ্যমে সহায়তা করে থাকে। আর্থিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে ইউরোপের কয়েকটি রাষ্ট্র বেইল আউট সুবিধা নিয়েছে।
বিশ্বব্যাপী এক দশক ধরে এ বিষয়ে আলোচনা হলেও বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা চার দশকেরও বেশি। যথেচ্ছ ঋণ প্রদানের কারণে মূলধন সংকটে পড়েছে বেশক’টি ব্যাংক। নানা সময়ে আর্থিক সুবিধাও পেয়েছে। আর এসব ব্যাংকে এখন আর্থিক কেলেঙ্কারির প্রতিযোগিতা চলছে।
খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অবশ্য ইউরোপে আর্থিক মন্দা বা দেনার কারণ হচ্ছে কাঠামোগত ত্রুটি। হলমার্ক বা বিসমিল্লাহ বা বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির হোতাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হলেও জনগণের কষ্টার্জিত করের টাকা দিয়ে সচল রাখা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে।
ক্ষুদ্রঋণের তহবিল ব্যবস্থার এ সংকট নিরসনে সরকারিভাবে অর্থের জোগান দিলে অসুবিধা কোথায়? এ সংকট দ্রুত সমাধানের পথ তৈরি করা দরকার সমন্বিতভাবে। অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বাধাগ্রস্ত হবে, তা অপ্রত্যাশিত।
এখানে ব্যর্থ হলে, তৃণমূলের মানুষের কাছে মনে হবে, ‘জীবন নামের রেলগাড়িটা পায় না খুঁজে ইস্টিশন/কোন লাইনে গেলে পাবে বলবে তারে কে এখন/কোথা থেকে ছেড়ে এলো যেতে হবে কতদূর/কোনখানে তার শেষ ঠিকানা/’।