সাজ্জাদ আলম খান: বছরজুড়েই সরগরম থাকবে রাজনীতির মাঠ। ধীরে ধীরে তার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে অর্থনীতিতেও। ব্যবসা-বাণিজ্যের চালকের আসনে যারা আছেন, তারা এখন থেকে ছক কাটছেন, নির্বাচন-উত্তর বিনিয়োগ ইস্যুতে। ভোট ঘনিয়ে এলে, আমাদের দেশে দরকষাকষি শুরু হয়ে যায়। সংঘবদ্ধ শক্তি আগেভাগেই নিজেদের পক্ষে দাবি আদায়ে মরিয়া হয়ে ওঠে। ভাবে, আর্থিক সেবা আদায়ে এখনই মোক্ষম সময়।
যেমনটি এ নির্বাচনের আগে বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ আদায় করতে তৎপর হয়েছে স্থানীয় উদ্যোক্তারা। বলছেন, এবার বিনিয়োগকারীর জাতি হিসেবে নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবে। আর শক্তিশালীরা ৫ বছর মেয়াদে সুবিধা নিতে চায় বলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সংঘবদ্ধ সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তিতে একসূত্রে গেঁথে ফেলার চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে যে দলের যত বেশি দক্ষতা, সে দলই তত বেশি জনসমর্থন আদায় করে থাকে। ইতিমধ্যে অর্থমন্ত্রীকে চাপে ফেলে অর্থনীতিকে সংস্কারমুক্ত রাখার কৌশলে জয়ী হয়েছেন অনেকে। এতে বিপুল জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হলেও সুফল পাচ্ছে শক্তিশালী চক্র।
সংসদ নির্বাচনের প্রভাবে আগামী বছর ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। এর পাশাপাশি চলতি বছরে অর্থনীতিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ। খাদ্যের ক্রমবর্ধমান দর বৃদ্ধি, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় শরিক হওয়া, রফতানি ও রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ানো। আর সর্বোপরি ব্যাংকিং খাতে লুটপাট বন্ধ ও অভ্যন্তরীণ সুশাসন ফিরিয়ে আনা। কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি এখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসায় বিনিয়োগ ভাবনায় বরাবরই ছেদ পড়ে।
উদ্যোক্তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। চারটি নির্বাচনী বছরের বিনিয়োগ পরিসংখ্যান অন্তত তাই বলছে। ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই অর্থবছরের বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল প্রায় সাড়ে ১৮ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরে যা ছিল প্রায় ২২ শতাংশ। তবে ২০০১ সালের নির্বাচনী বছরে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির চিত্রও অনেকটা এমন। বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধিতে ছিল ধীরগতি। ওই অর্থবছরে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও এর আগের অর্থবছরে ছিল এর সামান্য বেশি। রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতের পর ২০০৮ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই অর্থবছরে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ। আর এর আগের অর্থবছরে ছিল সাড়ে ৭ শতাংশের ওপরে।
আর সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে। ওই অর্থবছরে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি হয় ৬ দশমিক ৭ ভাগ। আর এর আগের অর্থবছরে ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। নির্বাচনকে ঘিরে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়ে থাকে। ক্ষমতার পালাবদল হলে কোন কোন খাত গুরুত্ব পাবে, তা নিয়ে চলে পর্যালোচনা। নীতি-কাঠামোর ধারাবাহিকতা থাকা নিয়ে দেখা দেয় এক ধরনের অস্থিরতা। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে, বিনিয়োগের জন্য ধীরগতিতে চলার নীতি অনুসরণ করে থাকেন উদ্যোক্তারা। আবার রাজনৈতিক দলগুলোর পেছনেও বিনিয়োগ করার রেওয়াজ এ দেশে অনেক দিনের। অনেক উদ্যোক্তার হয়তো ব্যয় বাড়ে; কিন্তু তা উৎপাদনশীল খাতে নয়। বর্তমান অর্থনীতির গতিধারা উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে তেমনভাবে অগ্রসর হচ্ছে না।
অর্থনীতি ও রাজনীতি একে অপরের পরিপূরক। অর্থনীতি পরিচালনাকারীরা রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকেন। সামনে ভোটার তুষ্ট করার জাতীয় বাজেট আসার কথা। অন্তত আমাদের ইতিপূর্বের অভিজ্ঞতা তাই বলে। তুষ্টি অর্জনের বাজেটে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বরাবরই থাকে। যদিও কাগজপত্রে মূল্যস্ফীতির চিত্র বেশ আশাব্যঞ্জক জায়গায় থাকলেও যাপিত জীবনের হতাশার কমতি নেই।
মূল্যস্ফীতির ঝড় বরাবরই রাজনীতিতে অস্বস্তি ছড়ায়; কিন্তু নীতিনির্ধারকরা বলে বেড়াচ্ছেন, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে সাধারণের। আর মাথাপিছু আয় তো ১৬১০ মার্কিন ডলার। জমিদারের পরিপূর্ণ ধানের গোলা যেমন অভুক্ত মানুষের কোনো কাজে লাগেনি, তেমনি এ মাথাপিছু আয় প্রান্তিক মানুষের জীবনেও তেমনটাই। রোগ-শোক-দুঃখ-খরা-অতিবৃষ্টিতে এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায় অনেক মানুষ। গবেষণা সংস্থা সানেমের হিসাবে গত বছরে চালের দর বৃদ্ধিতে গরিব মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৫ লাখ ২০ হাজার।
অন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি, বিনিয়োগ স্থবিরতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার সংকট। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ, চুক্তি কার্যকরে বিলম্ব ও ব্যবস্থাপনা সংকট। ২২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থনীতির এই দেশে বেশ কয়েকটি বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৩.৭ বিলিয়ন ডলারের পদ্মা সেতু, ২.৭ বিলিয়ন ডলারের মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার, অর্ধশত অর্থনৈতিক জোন এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর অন্যতম।
নির্বাচনের বছর কর্মোদ্যোগী প্রকল্প অগ্রাধিকার হারাতে থাকে। তবে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত এবং দারিদ্র্য ও আয়ের অসমতা কমাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। বাংলাদেশের বার্ষিক বিনিয়োগ ২০২০ সালের মধ্যে ৩৪.৪ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। এজন্য ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি বাহ্যিক সম্পদের প্রয়োজন। যদিও সরকারি খাতের বিনিয়োগ বিগত কয়েক বছর আগের তুলনায় জিডিপির ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ৭ শতাংশ হয়েছে; কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ২২ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের জিডিপি পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি বা পিপিপি অনুসারে ৬২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল এবং ২০৫০ সালে তা ৩০৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, তলানিতে এর সুফল মিলবে কিনা।
অর্থ পাচারের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। এমন আশঙ্কারও যথেষ্ট ভিত্তি রয়েছে। পানামা পেপারস, প্যারাডাইস পেপারস, সুইস ব্যাংক- যে নামেই তালিকা হোক না কেন, বাংলাদেশিদের নাম থাকবেই। সেকেন্ডহোম, বেগমপাড়ার খবর হামেশাই শোনা যায়। মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগ টানতে রাজধানীতে রোডশোও হয়েছে। যদিও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কড়াকড়িতে ততটা প্রকাশ্যে আসতে পারেনি। তথ্য-প্রযুক্তির এ যুগে অবশ্য রোডশোর তেমন প্রয়োজন নেই।
ওয়েবসাইটে মিলে নানান তথ্য। নির্বাচনী বছরে এসব খুঁজে খুঁজে অনেকেই ব্যক্তি নিরাপত্তার নামে দেশের অর্থ পাঠিয়ে দিয়ে থাকেন। অর্থ পাচার বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না সরকারি সংস্থা। ওভার ইনভয়েস, পণ্য আনার ঘোষণায় মিথ্যা তথ্য, প্রবাসী শ্রমিকদের অর্থ সংগ্রহ করে বিদেশেই রেখে দেয়া, এর পরিবর্তে স্থানীয়ভাবে সরবরাহ করা, টাকা ডলারে কনভার্ট করে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বন্ধ করা যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চোখ রাঙানি, দুদকের হুশিয়ারি, এনবিআরের কড়া নির্দেশনা- এ ক্ষেত্রে বরাবরই উপেক্ষিত হচ্ছে।
দেশের চরম দারিদ্র্যের হার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তুলনামূলক কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে আশাবাদ প্রকাশ করা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য নিরসন হবে। যদিও গত কয়েক বছরে দেশের ধনী-গরিব বৈষম্য অনেক বেড়েছে। ধনিক শ্রেণীর আয় যে হারে বেড়েছে, সে হারে বাড়েনি গরিবের। দেশের মোট আয়ের ২৮ শতাংশই রয়েছে ৫ শতাংশ ধনাঢ্য পরিবারের হাতে। আর সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ পরিবারের আয় মাত্র দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০১০ সালে আয়ের দিক থেকে সবচেয়ে পেছনে থাকা ৫ শতাংশ পরিবার দেশের মোট আয়ের দশমিক ৭৮ শতাংশ আয় করত। ২০১৬ সালে তা আরও অনেক কমে দশমিক ২৩ শতাংশ হয়েছে।
অন্যদিকে ২০১০ সালে সবচেয়ে বেশি আয় করা ৫ শতাংশ পরিবারের কাছে দেশের মোট আয়ের ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ ছিল। ২০১৬ সালে যা বেড়ে ২৭ দশমিক ৮৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আয় বৈষম্যের এ পরিস্থিতি দেশের জন্য উদ্বেগজনক।
কয়েক বছর ধরে প্রান্তিক আয়ের শ্রমজীবীদের প্রকৃত মজুরি বাড়ছে না। দেশের যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তার সুবিধা সবাই পাচ্ছে না। আবার কর্মসংস্থান বৃদ্ধির গতিও কমে গেছে। ফলে সবার জন্য অর্জনযোগ্য এবং কর্মসংস্থানমুখী প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। আয় বিভাজনের চিত্র তা স্পষ্ট করছে। নির্বাচনী বছরে ওই বৈষম্য দূর করতে রাজনৈতিক দলগুলো কি মনোযোগী হবে? তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ক্ষুধা-দারিদ্র্য নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কিংবা প্রতিশ্রুতি কী থাকবে- তা দেখতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিধ্বনিত হোক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে, দিতে হবে ভাষা- এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে, ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা।’
লেখক: সাংবাদিক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক। ই-মেইল: sirajgonjbd@gmail.com