বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই শিশুদের কল্যাণ

0
139

শেখ হাসিনা ১৬ মার্চ, ২০১৬
১৭ মার্চ জাতির জনকের জন্মদিন উপলক্ষে শ্রাবণ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত রাজীব পারভেজ সম্পাদিত ‘নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু’ বই থেকে পুন:প্রকাশিত

১৯২০ সালে ১৭ মার্চ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তাই মার্চ মাস বাঙালি জাতির জীবনে এক গৌরবের মাস। স্বাধীনতার মাস জাতির পিতার জন্মের মাস। আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি জাতির পিতার পবিত্র স্মৃতির প্রতি। স্মরণ করছি ১৫ আগস্টে ঘাতকদের হাতে নিহত শীহদদের। শ্রদ্ধা জানচ্ছি জাতীয় চার নেতাকে। স্মরণ করছি-মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ নির্যাতিত মা-বোনকে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সহমর্মিতা জানাচ্ছি।

জাতির পিতা ছিলেন বিশ্বের শোষিত মানুষের নেতা। বিশ্ব মানবতার নেতা। তার জীবন ও কর্মের প্রতিটি পাতায় রয়েছে সংগ্রামের ইতিহাস। সত্য, ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। বাংলার মাটি ও মানুষের জন্য জাতির পিতা লোভ-লালসা, ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে দীর্ঘ ২৩ বছর সংগ্রাম করেছেন। ১৩ বছরেরও বেশি সময় জেল খেটেছেন। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমি বাঙালি , আমি মানুষ, আমি মুসলমান, মুসলমান একবার মরে দুইবার মরে না’। জাতির পিতা আমাদের দিয়েছেন বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে বাঁচবার অধিকার। আজ যে পদ-পদবি ব্যবহার করে গর্বিত হই তা সম্ভব হয়েছে আমরা স্বাধীন জাতি বলে। আর জাতির পিতা এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জনক। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুর্নগঠনে ব্যস্ত ঠিক তখনই একাত্তরের পরাজিত শক্তি ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট কালরাতে তাকে সহপরিবারে হত্যা করা হয়। অন্ধকার নেমে আসে তার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলায়’।

এর পরের ইতিহাস হত্যা ক্যু-ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। বাংলাদেশকে যুগ যুগ পিছিয়ে দেয়ার ইতিহাস। তখন সামরিক জান্তার বুটের তলায় পিষ্ট হয় মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং পবিত্র সংবিধান। বন্দুকের জোরে জিয়াউর রহমান অবৈধ ক্ষমতা দখল করে। ইনডেনমিটি অর্ডিনেন্স জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করে। দূতাবাসে চাকরি দেয়। যুদ্ধাপরাধীদের নাগরিকত্ব দেয়। রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার করে। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করে। মানুষ ফিরে পায় আস্থা ও আত্মবিশ্বাস।

১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনকাল ছিল বাংলাদেশের জন্য স্বর্গযুগ। এ সময় আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করি। দ্রব্যমূল্য হ্রাস পায়। মূল্যস্ফ্রীতির হার ১.৫৯ শতাংশে নেমে আসে। এসময় আমরা গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পাদন করি। তখন সাক্ষরতার হার ৬৫ শতাংশে উন্নীত হয়। নারী ও শিশু উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বৃদ্ধিসহ প্রতিটি সেক্টরে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে।

কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট ২০০১ সালে কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে শুরু করে হত্যা-সন্ত্রাস-ধর্ষণ-সংখ্যালঘু নির্যাতন আর দুর্নীতির উৎসব। আওয়ামী লীগের ২২ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করে। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে পঙ্গু করে দেয়। বাংলাভাইসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনকে তারা প্রকাশ্যে মদদ দেয়। জঙ্গিরা দেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে ৫শ’র বেশি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। পিরোজপুরে দুই বিচারককে হত্যা করে। আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালায়। আইভি রহমানসহ ২২ জন নেতাকর্মী নিহত হন। আহত হন কয়েক’শ নেতাকর্মী। হাওয়া ভবন সৃষ্টি করে বিএনপি এবং তার সন্তানেরা রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুটপাট করে, পাচার করে। তারা বংলাদেশকে দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করে। বিদেশে বাংলাদেশ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের দেশ হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত হয়।

জনগণের বিপুল ম্যাডেন্ট নিয়ে আমরা আবার ২০০৯ সালে সরকার গঠন করি। বিএনপি-জামায়াত আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অচলাবস্থা কাটিয়ে তুলে আমরা আবার দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাই। ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ পুনরায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে সরকার পরিচালনা করার সুযোগ দিয়েছে। আমরা উন্নয়নের ধারাবহিকতা রক্ষা করেছি। গত ছয় বছর অর্থনীতির প্রতিটি সূচক ছিল ইতিবাচক। জিপিডি প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৬.২ শতাংশে নেমে এসেছে। নিত্যপণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে।

আমরা বিদেশে চাল রফতানি করছি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে ১১৯০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। দেড় কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ৫ কোটির বেশি মানুষ নিন্মবৃত্ত থেকে মধ্যবিত্ত উঠে এসেছে। দারিদ্রের হার ২৪ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এখন ১৩ হাজার ২৮৩ মেগাওয়াট। নিজস্ব অর্থায়নে আমরা পদ্ম সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করেছি। সারাদেশে ৫ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টার চালু করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ এসব কেন্দ্র থেকে ২০০-এর বেশি সেবা পাচ্ছেন। ১২ হাজার ৫৫৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ৩ হাজার ৮৮১টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে জনগণ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন। প্রায় শতভাগ ছেলেমেয়ে বিদ্যালয় যাচ্ছে। আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিশ্বের সামনে বাংলাদেশ আজ রোল মডেল। বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এগিয়ে যাওয়া পাঁচটি দেশের একটি বাংলাদেশ।

জাতির পিতা শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক করেছিলেন। শিশুদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে ১৯৭৪ সালে শিশু আইন প্রনয়ণ করেছিলেন। আমরা জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই শিশুদের কল্যাণে কাজ করছি। ২০১১ সালে আমরা জাতীয় শিশুনীতি প্রনয়ণ করেছি। শিশুর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং বৈষম্য বন্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। শিশুদের জন্য আমরা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছি। বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় খেলার সরঞ্জাম ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বছরের প্রথম দিনে বিতরণ করা হচ্ছে বিনামূল্যে রঙিন পাঠ্যপ্রস্তুক। শিশুর ঝরে পড়া রোধে বিদ্যালয়ে শিশুবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, মিড ডে মিল চালু করা হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল বই ই-বুকে রূপান্তর করেছি। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও আইসিটি ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আমরা প্রতিটি বিদ্যালয়বিহীন গ্রামে বিদ্যালয় স্থাপন করছি। শ্রমজীবী কিশোর-কিশোরী ও অনগ্রসর পরিবারের শিশুদের জন্য শিশুবান্ধব শিখন কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। শিশুদের প্রতিভা ও উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশে ২০১২ সাল থেকে ভাষা ও সাহিত্য, দৈনন্দিন বিজ্ঞান, গণিত ও কম্পিউটার এবং বাংলাদেশ স্টাডিজ এই চার বিভাগে সৃজনশীল মেধা অণ্বেষণ কাযক্রম পরিচালিত হচ্ছে। শারীরিক ও মানসিক বিকাশের লক্ষে প্রাথমিক ছাত্রদের জন্য বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ এবং ছাত্রীদের জন্য বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু করা হয়েছে।

শিশুদের নেতৃত্ব বিকাশে আমরা ২০১০ সাল হতে প্রতিটি বিদ্যালয়ে স্টুডেন্টস কাউন্সিল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি। ২০১১ সালে হতে দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাএ-ছাত্রীদের অংশগ্রহণে আন্তঃপ্রাথমিক বিধ্যালয় ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হচ্ছে। পথশিশু, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ও বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিশুদের কল্যাণে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশুদের কল্যাণে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছি। কারাগারে আটক শিশুদের সংশোধন ও পুর্নবাসন করার মাধ্যমে তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে।

সারাদেশের শিশু বিকাশ কেন্দ্রে শিশুদের জন্য কিডস্ কর্নার ও সাংস্কৃতিক উপস্থাপনার জন্য উন্মুক্ত মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। শিশুদের জন্য জাতির পিতার জীবন ও কর্মভিত্তিক গ্রন্থ প্রকাশ এবং পাঠ্য বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সংযোজন করা হয়েছে। আমরা দ্বি-বার্ষিক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং উপজেলা পযায় থেকে জাতীয় পযায় পর্যন্ত শিশু নাট্য প্রতিযোগিতা ও উৎসব আয়োজন করছি। শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়নকে আমরা অগ্রাধিকার দিয়েছি। শিশু মৃত্যুহার হ্রাস ও শিশু স্বাস্থ্য রক্ষায় সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ আমরা এমজিডি অ্যাওয়ার্ড ও নাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছি।

আমরা যখন শিশুদের জন্য, দেশের উন্ননের জন্য কাজ করছি তখন বিএনপি নেত্রী কী করছে আপনারা জানেন। তাদের হাত থেকে ছোট্ট শিশুও রেহাই পায়নি। বোমা মেরে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে তারা স্কুলগামী শিশুদের হত্যা করেছে। আপনাদের মনে আছে, তাদের সহিংসতা ও নাশকতার কারণে ২০১৩ সালে মাসের পর মাস ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে যেতে পারেনি। নির্বাচন বানচাল করতে ৫৮২টি স্কুল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। বোমা মেরে স্কুলগামী শিশুদেরকে হতাহত করেছিল।

জাতির পিতা শিশুদের গভীরভাবে ভালোবাসতেন। এ কারণে তার জন্মদিনে শিশুদের জন্য উৎসর্গ করে আমরা জাতীয় শিশুদিবস ঘোষণা করেছি। জাতির পিতা ছাত্রজীবন থেকেই দরিদ্র-অসহায় সহপাঠীদের সাহায্য করতেন। তাদেরকে আপন করে নিতেন। আমি চাই তোমরা জাতির পিতার আদর্শকে ধারন করে সবসময়ই দরিদ্র, অসহায় ও প্রতিবন্ধী শিশুদের পাশে দাঁড়াবে। তোমাদের মতো আমারও একটি ছোট্ট ভাই ছিল। ঘাতকরা সেইদিন তাকেও রেহাই দেয়নি। আমি তোমাদের মাঝে আমার সেই ছোটভাই রাসেলকে খুঁজে ফিরি। তোমাদের জন্য জাতির পিতা এই সুন্দর দেশ দিয়ে গেছেন। আমার প্রত্যাশা, তোমরা বড় হয়ে জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে তার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলবে। বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে মার্যাদাপূর্ণ আসনে তুলে ধরবে।

শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ আসুন, আমরা শিশুদের জন্য নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তুলি। একটি শিশুর শরীরেও যেন আর কোন বোমার আঘাত না লাগে। আসুন, শিমুদের সুন্দর আগামীর জন্য আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here