বার বার নারী নির্যাতনকারীদের পক্ষ নিচ্ছে সিটি ব্যাংক। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্তদের পক্ষ নিয়ে আনীত অভিযোগের চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত মামলা পরিচালনা ব্যয় করে প্রতিষ্ঠানটি। সেখানে অন্যান্য সকল জাতীয় এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়ম হলো যার নামে অভিযোগ ব্যক্তিগতভাবে তিনিই এইসব অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করবেন। ততদিন তিনি প্রতিষ্ঠান এবং প্রাতিষ্ঠানিক কোন সুবিধা পাবেন না। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এটাই নিয়ম। কিন্তু নিজেদের আন্তর্জাতিক মানের দাবি করা সিটি ব্যাংক নিজেই সেসব আইনের তোয়াক্ক করছেন না। বরং ঢাল হয়ে পাশে দাঁড়াচ্ছেন নিজেদের কর্মকতাদের। এরমধ্যেই তিনটি নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এমডিসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। আরেকটি মামলায় দন্ডিত হয়েছেন প্রতিষ্ঠানের আরেক কর্তকর্তার ।
আলোচিত সেসব মামলার রায় কি হতে পারে সকলেরই জানা। রায় হয়, বিভিন্ন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে। আর প্রতিবেদনগুলো তৈরি করে মানুষ। মানুষ মানেই দোষে-গুনে, লোভে-আকাঙ্খায় গড়া এক দলা মাংস পিন্ড। ফলে রায়গুলো খুব সহজেই নিজেদের বগলদাবা করতে পারছেন সিটি ব্যাংক। এর প্রথম প্রমাণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার টিটোর বিরুদ্ধে করা স্ত্রী তাবাসসুম কায়সারের মামলা। সে মামলায় সম্প্রতি অব্যহতি পেয়েছেন তিনি। এরপর আসবে ব্যাংকের এমডিসহ তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মনিরা সুলতানা পপি’র মামলা। সেই মামলাও খারিজ করে দিয়েছে আদালত। সবশেষ সিটি ব্যাংকের কর্মকর্তা সোহানুর রহমান সোহানের বিরুদ্ধে দায়ের করা সাদিয়া আফরীন যূথীর মামলা। এটি এখন চলমান। তবে কেবল একটি মামলায় ২০২৪ সালের এপ্রিলের ২৯ তারিখে পাঁচ মাসে জালিয়াতির মাধ্যমে সিটি ব্যাংক ও এর গ্রাহকদের হিসাব থেকে আড়াই কোটি টাকা সরিয়ে নেয়ার অভিযোগে কার্ড ডিভিশনের প্রধান মুসাব্বির রহিকে চারটি ধারায় ২৬ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মামলা (১)
সাদিয়া আফরীন যূথীর বয়স মাত্র ২১। বাড়ী কুতুবপুর, ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ। পারিবারিকভাবে বিয়ে ঠিক হয় ঢাকার হাতির ঝিলের বাসিন্দা সোহানুর রহমান সোহানের সাথে। সোহানের বড় যোগ্যতা তিনি স্বনামখ্যাত সিটি ব্যাংকের একজন মধ্যম সারির কর্মকর্তা সে। বিয়েও হয় ধুমধামে ২০২০ সালের নভেম্বরের ১৩ তারিখে। মোহরানা ধার্য করা হয় ৫ লক্ষ টাকা। বিয়ের পরপরই ১০ লাখ টাকা নিযে নেয় সোহানের পরিবার। পরে আরো টাকার চাপ দেয়। সেই আবদার পূরণ করতে না পারায় চলে শারিরিক ও মানসিক নির্যাতন। এটা চলতে থাকে নিয়মিত। নির্যাতন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে ২০২৩ সালের আগস্টের ২০ তারিখে আদালতের দ্বারস্ত হয়ে মামলা করেন, মামলা ন: ৮৮৭/২০২৩। মামলা দায়েরের পর জানা যায়, এই সোহানের আগেও বিয়ে হয়েছে এবং যূথীকে বিয়ের সময় এই সত্যটি গোপন করেছেন সোহান। ২০১৫ সালে ফাতেমাতুজ জোহরা নামের একজনকে তিনি বিয়ে করেন। প্রথম বউ থাকার পর দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে কিছু শর্ত পুরণ করতে হয়, তা অত্যন্ত চাতুরতার সাথে এভয়েড করেছেন সিটি ব্যাংকের কর্মকর্তা সোহানুর রহমান সোহান। সেই মামলা এখনো চলমান। আগাম জামিন নিয়ে মামলা চালাচ্ছেন সোহান।সিটি ব্যাংকে এখনো বহাল তবিয়তেই আছেন তিনি। এ নিয়ে সিটি ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান হাসান মো: লাভলু’র সাথে দেখা করেন যূথী ও তার পরিবার। তাকে পরে জানাবেন বলে জানিয়েছেন সিটি ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান হাসান মো: লাভলু’।
মামলা (২)
২০১৯ সালের ১৯ আগষ্ট যৌন হয়রানির অভিযোগে সিটি ব্যাংকের এমডিসহ তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে, মামলা দায়ের করা হয়। রাজধানীর গুলশান থানায় দায়ের করা মামলায় আসামি করা হয় সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন, হেড অব সিএসআরএম আবদুল ওয়াদুদ ও বোর্ড সেক্রেটারি কাফি খানকে। মামলার বাদী সিটি ব্যাংকের সাবেক সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট মনিরা সুলতানা পপি। মামলার বাদী গণমাধ্যমকে জানান, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্য দুই আসামি আমাকে অব্যাহতভাবে ইভটিজিং করেন। তাদের কুপ্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এমনকি শুক্রবার সরকারি ছুটির দিন তার কাছে ব্যাংক থেকে চাকরিচ্যুতির চিঠি পাঠানো হয়। বাদী আরও বলেন, এ তিন কর্মকর্তার কুরুচিপূর্ণ আচরণের বিষয়টি বহু আগেই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে জানানো হয়। কিন্তু তেমন কোনো ফল না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে আইনের আশ্রয় নেন। মামলাটি করা হয়েছিলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৪০৬/৫০৬ ধারায়। যেখানে শ্লীলতাহানি ও শ্লীলতাহানিতে সহায়তা প্রদান করা এবং অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ ও হুমকি প্রদর্শনের অপরাধের কথা বলা আছে। সেই মামলার এজাহারে বলা হয়, ব্যাংকে যোগদান করার পরপরই মাসরুর আরেফিনের নিয়মিত ইভটিজিংয়ের শিকার হন তিনি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় এমডির এসব আচরণ সহ্য করেই তাকে কাজ করতে হয়। ২০১১ সালে অপর আসামি হেড অব সিএসআরএম আবদুল ওয়াদুদ গাড়িতে লিফট দেয়ার নাম করে তার ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে বসেন। লিফটের ভেতরে, সিঁড়িতে অফিস চলাকালীন তার হয়রানির শিকার হতে হয়। এ ঘটনা বোর্ডের চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার টিটো এবং তাবাসসুম কায়সার জানেন। বোর্ডে আলোচনায় আসার পর কনসালট্যান্ট রাজা দেবনাথ লিখিত অভিযোগ করতে বলেন। এরপর ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তারা তাকে নিয়ে আলোচনায় বসেন। এ ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে একই ফ্লোরে কাজের পরিবেশ নেই জানানোর পর সেপ্টেম্বরে মনিরা সুলতানাকে ট্রান্সফার করা হয়। এরপর ৩১ ডিসেম্বর ডিএমডি (অপারেশন) মাহিয়া জুনেদ এবং মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান তাকে চাকরি খুঁজতে বলেন। এই বাদীর দাবি ছিলো, অনেক আগেই গুলশান থানায় জিডিও করি। কিন্তু ব্যাংক কর্মকর্তারা পুলিশকে ম্যানেজ করে ফেলেন। ফলে তিনি আইনগত সহায়তা পাননি। এ কারণে পুলিশ মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায়। দিনভর থানায় বসিয়ে রেখেও মামলা নেয়নি। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করি। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে পুলিশ মামলা নিতে বাধ্য হয়।
মামলা (৩)
২০২৩ সালের ১ লা জানুয়ারি বেসরকারি সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পারটেক্স স্টার গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার টিটোর বিরুদ্ধে মামলা করেন স্ত্রী তাবাসসুম কায়সার ওরফে ময়না। এতে জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। বাদী ময়নার পক্ষে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মোট চারটি মামলার আবেদন করা হয়। আদালত একটি মামলা আমলে নিয়ে আজিজ আল কায়সারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। অপর ৩টি আবেদন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় রেকর্ড করে পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে আজিজ আল কায়সার বর্তমানে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে আছেন।এদিকে মামলা দায়েরের পর নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে গেলো বছরের ২৮ ডিসেম্বর গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ময়না। এতে অভিযোগ করা হয়, বাসায় ঢুকে সাংবাদিক পরিচয়ে তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল ও র্যা বের লোক পরিচয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এছাড়া স্বামী আজিজ আল কায়সারের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ করেন তিনি।
মামলা (৪)
২০২৪ সালের এপ্রিলের ২৯ তারিখে পাঁচ মাসে জালিয়াতির মাধ্যমে সিটি ব্যাংক ও এর গ্রাহকদের হিসাব থেকে আড়াই কোটি টাকা সরিয়ে নেন কার্ড ডিভিশনের প্রধান মুসাব্বির রহিম। সেই অপরাধে ব্যাংকের সাবেক সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কার্ড ডিভিশনের প্রধান মুসাব্বির রহিমকে চারটি ধারায় ২৬ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পাশাপাশি তাকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক সৈয়দ আরাফাত হোসেন এই রায় দেন। ওই ব্যাংক কর্মকর্তাকে দুটি ধারায় ৭ বছর করে ১৪ বছর কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৪০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, একটি ধারায় ১০ বছরের কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং অন্য একটি ধারায় ২ বছরের কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মামলার অভিযোগ অনুযায়ী. ২০১৫ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত নানা সময়ে জালিয়াতির মাধ্যমে সিটি ব্যাংক ও এর গ্রাহকদের হিসাব থেকে টাকা সরিয়ে নেন মুসাব্বির রহিম। ২০১৬ সালের ১৮ অগাস্ট ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের আইন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট এ কে এম আইয়ুব উল্যাহ বনানী থানায় মামলা করেন।
প্রশ্ন এখন এটাই যে, এর আগেও নারী নির্যাতনের অভিযোগেরও কোন সমাধান করেনি সিটি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তারা তাদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোন অ্যাকশন নেন না। উল্টা অভিযোগকারী নারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রতিষ্ঠান (সিটি ব্যাংক) এবং প্রতিষ্ঠানের অর্থ ব্যবহার করেন। ফলে অভিযোগকারীরা হয়ে পড়েন কোনঠাসা, ন্যায়বিচার হতে বঞ্চিত হন অভিযোগকারীরা। কারণ সিটি ব্যাংকের হাত অনেক লম্ব। এখানে কর্মরত পুরুষ কর্মকর্তারা মনেই করেন, সিটি ব্যাংক তার প্রতিষ্ঠানের স্বার্থেই তার কর্মীদের রক্ষাকবজের কাজ করবে। যেভাবে তাদের প্রধানরা প্রতিষ্ঠান থেকে সহায়তা পেয়েছে, তেমনি তারাও সহায়তা পাবেন। তারা পাচ্ছেনও।
মামলা (৫)
গ্রাহকের স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) ৭০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সিলেটে সিটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে ১২ কোটি টাকার মামলা দায়ের করা হয়েছে। বুধবার (১২ জানুয়ারি ২০২২) দুপুরে সিলেট জেলা যুগ্ম আদালতে মামলাটি (নং-০২/২০২২) দায়ের করেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী নগরের উত্তর পীরমহল্লার বাসিন্দা সৈয়দ আখলাক মিয়া। মামলায় ছয় কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করেছেন তিনি। তারা হলেন—সিটি ব্যাংক রাজধানীর গুলশান প্রধান শাখার ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ব্যাংকের সিলেটের বন্দরবাজার শাখার উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম), সিলেটের জিন্দাবাজার শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান শাখার ডেপুটি গভর্নর। মামলায় বাদী এফডিআরের আত্মসাৎকৃত মূল টাকা, লভ্যাংশ ও মানহানির ঘটনায় ১২ কোটি ১৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দাবি করেছেন। বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট বিপ্রদাস ভট্টাচার্য বলেন, প্রবাসী সৈয়দ আখলাক মিয়া দীর্ঘদিন বিদেশ থেকে দেশের স্বার্থে রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। তার কষ্টার্জিত টাকা সিটি ব্যাংকে রেখেছিলেন। সিটি ব্যাংক তা আত্মসাৎ করেছে। এটা দুঃখজনক ও ন্যক্কারজনক। ঘটনাটি ২০০৮ সালের। বাদী সিটি ব্যাংকের এমডি ও ব্যাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেন। কিন্তু সিটি ব্যাংক উল্টো বাদীকে হয়রানি করতে তার ওপর ফৌজদারি আইনে সিআর মামলা দায়ের করে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের ধারণা ছিল, যদি গ্রাহক তথা বাদীকে জেলে ঢোকানো যায়, তবে আপসে নিষ্পত্তি করতে বাধ্য হবেন। মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে আবারও হয়রানি করা হয়। ওই মামলা থেকে তিনি নিম্ন আদালতে খালাস পাওয়ার পরও খালাস আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলার শুনানি করানো হলো। এরপর মহানগর আদালতের খালাস আদেশ উচ্চ আদালত বহাল রাখেন। তারপরও সিটি ব্যাংক ক্ষান্ত হয়নি। মামলাটি হাইকোর্টের আপিল বিভাগে নেওয়া হয়। বর্তমানে মামলাটি চলমান রয়েছে। এটা ইতিহাসের একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা গ্রাহকের টাকা ব্যাংক মেরে গ্রাহককে জেলে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য মামলা করা হয়। এ ঘটনাটি খুবই নিন্দনীয়।