সরকারের মেয়াদ হবে ৪ বছর?

0
8

সংবিধান সংস্কার কমিশনের আহ্বানে লিখিত প্রস্তাবনা পেশ করেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) জাতীয় সংসদের দক্ষিণ-পশ্চিম ব্লকের দ্বিতীয় লেভেলে অবস্থিত কেবিনেট কক্ষে ৬৯ দফা প্রস্তাবনা পেশ করে সংগঠনটি। জাতীয় নাগরিক কমিটি তাদের প্রস্তাবে বলেছে, সরকারের মেয়াদ হবে ৪ বছর। দুবারের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের আহ্বানের ভিত্তিতে জাতীয় নাগরিক কমিটির সংবিধান প্রস্তাব:
বিদ্যমান সংবিধানের সংস্কার নয়; সম্পূর্ণ নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। বিদ্যমান সংবিধানের ৪(ক) -এর ন্যায় কোনো অনুচ্ছেদ থাকবে না। সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহে কেবলমাত্র জাতীয় প্রতীক প্রদর্শিত হবে।

মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রকে প্রথম রিপাবলিকের প্রস্তাবনা হিসেবে গ্রহণ করে তা সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। দ্বিতীয় রিপাবলিকের প্রোক্লেমেশন জারি করে তা নতুন সংবিধানের প্রস্তাবনা হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। নতুন লিগ্যাল ফ্রেমঅর্ডারের অধীন গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। সংবিধান প্রণয়ন সম্পন্ন হলে উক্ত গণপরিষদই আইনসভায় রূপ নেবে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সকল অংশীজনের কাছ থেকে পাওয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান সংস্কার কমিশন কর্তৃক প্রণীত প্রস্তাব কেবল সরকারের কাছে নয়; বরং সকল অংশীজনের কাছেই পাঠাতে হবে এবং তাদের মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত হওয়া খসড়া গণপরিষদে উত্থাপিত হবে। এটাই হবে গণপরিষদের সংবিধান বিতর্কের মূল দলিল।

সকল স্তরের জনগণের মতামত গ্রহণ করতে হবে। কেবল ওয়েবসাইটে মতামত গ্রহণের মাধ্যমে এ কাজ করা সম্ভব নয়। সংবিধানে প্রত্যেক জাতিসত্তার স্বীকৃতি থাকতে হবে। বাংলাদেশের নাগরিকগণ ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে পরিচিত হবে।

সংবিধানের প্রস্তাবনায় গণসার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি থাকতে হবে। সংবিধানে গণভোটের বিধান থাকতে হবে। গণভোট ছাড়া কেবলমাত্র আইনসভার দুই-তৃতীয়াংশের জোরে সংবিধান সংশোধন করা যাবে না।

জাতীয় নাগরিক কমিটি সংবিধানের পাঁচটি মূলনীতি প্রস্তাব করেছে। সেগুলো হলো—সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্র।

রাষ্ট্রপতি
নাগরিক কমিটির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি রিপাবলিকের নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হবেন। রিপাবলিকের সকল কর্ম তার নামেই সম্পাদিত হবে। জনগণের সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন। দুইবারের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না। একজন রাষ্ট্রপতি পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচন করতে পারবে না।

রাষ্ট্রপতি সংসদের উভয়কক্ষের যৌথসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবেন। এছাড়া আইনের দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে মনোনীত ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন। অন্যান্য সাংবিধানিক পদেও আইনের দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে নিয়োগ দেবেন।

রাষ্ট্রপতি দণ্ড মওকুফ বা ক্ষমা ঘোষণা করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে সংসদের উচ্চ কক্ষের প্রস্তাব/পরামর্শ লাগবে। রাষ্ট্রপতি যেকোনো আইন-বিধান-বিধি-প্রবিধান-নীতি বা চুক্তি/স্মারক অনুমোদন বা স্বাক্ষরের আগে সংবিধানানুগ হয়েছে কিনা তা পরীক্ষার জন্য সুপ্রীম কোর্টের সংশ্লিষ্ট বিভাগে মতামতের জন্য পাঠাতে পারবেন।

যেকোনো ব্যক্তি, সংস্থা, কর্মবিভাগ সম্পর্কে তদন্ত/নিরীক্ষার জন্য ন্যায়পালকে নির্দেশ দিতে পারবেন। অধ্যাদেশ প্রণয়নের আগে তা ক্রমানুসারে সংসদের উচ্চকক্ষ বা সংসদীয় কমিটি বা সুপ্রীম কোর্টের সংশ্লিষ্ট বিভাগের মতামত/পরামর্শ গ্রহণ করবেন।

যেকোনো বিষয়ে আলোচনার জন্য রাষ্ট্রপতি সংসদে প্রস্তাব পাঠাতে পারবেন। রাষ্ট্রপতির কাস্টিং ভোট থাকবে। রাষ্ট্রপতি তিন বাহিনীর প্রধান থাকবেন এবং জরুরি অবস্থা বিষয়ে উচ্চকক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে। জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য সংসদের উভয়কক্ষের সভায় পাশ হওয়া প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে আসতে হবে। নিম্নকক্ষের অনুপস্থিতিতে কেবল উচ্চকক্ষ প্রস্তাব পাঠাতে পারবে। জরুরি অবস্থা চলাকালীন মৌলিক অধিকার রদ করা যাবে না। কেবল সংসদ নেতার পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি সময়ের আগে সংসদ ভেঙে দিতে পারবেন।

প্রধানমন্ত্রী
নাগরিক কমিটি প্রস্তাব করেছে, প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি একইসাথে নিজ দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হতে পারবেন না। জীবনে দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না এবং প্রধানমন্ত্রী হবার পর রাষ্ট্রের আর কোনো পদেই তিনি আসীন হবেন না। কোম্পানি বা ব্যবসায়ী উদ্যোগের ক্ষেত্রেও বিধি-নিষেধ থাকবে। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সকল সম্পদ এবং সম্পত্তি স্টেট ব্যাংকের অধীনে চলে যাবে।

কোনো সাংবিধানিক পদের নিয়োগে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে পারবেন; তবে তা পালন করা রাষ্ট্রপতির জন্য আবশ্যকীয় হবে না। সাংবিধানিক পদে নিয়োগ ও অপসারণ আইন দ্বারা নির্ধারিত হবে। সাংবিধানিক পদে আসীন কাউকে অপসারণ করার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর থাকবে না।

৭০ অনুচ্ছেদের কঠোরতা খর্ব করতে হবে। সংসদ সদস্যগণ দল বদল করলে তথা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিলে বা দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করলে বা অব্যাহতি দেয়া হলে তার সাংসদ পদ শুন্য হবে। আস্থা ভোটে দলের বিপরীতে ভোট দেয়া যাবে না। অন্য যেকোনো বিষয়ে তিনি স্বাধীন থাকবেন, দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন। নাগরিক কমিটি আরও প্রস্তাব করেছে, সরকারের মেয়াদ হবে ৪ বছর।

প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীসভার যাবতীয় সিদ্ধান্ত রদ করা বা চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা সংসদীয় দলের থাকবে। প্রধানমন্ত্রী হবেন সম ব্যক্তিদের মাঝে প্রথম তথা প্রধানমন্ত্রী ক্রমবিচারে প্রথম হবেন; ক্ষমতা বিচারে নয় । মন্ত্রীসভার সদস্যদের প্রধানমন্ত্রী চয়ন করবেন। তবে সংসদের তাতে অনুমোদন নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীদের দপ্তর বন্টন করবেন এবং রদবদল করতে পারবেন। তবে অপসারণ করতে হলে সংসদের অনুমোদন নিতে হবে।

সংসদীয় কমিটির ক্ষমতা বাড়াতে হবে। মন্ত্রীসভার যাবতীয় সিদ্ধান্ত সংসদীয় কমিটি চ্যালেঞ্জ করতে পারবে। শুনানি এবং সুপারিশের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত আইনসভায় পাঠাবে মন্ত্রীসভা। সুপারিশ আইনসভায় ভোটাভুটির মুখোমুখি
হবে।

প্রধানমন্ত্রী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেওয়ার অধিকারী হবেন। তবে তা পালন করা রাষ্ট্রপতির জন্য আবশ্যকীয় হবে না। আইনসভাই কেবল সিদ্ধান্ত নেবে। তবে জরুরি আইন/আদেশ সর্বোচ্চ আদালতের কাছে পাঠাতে হবে। আদালত আইনটির সাংবিধানিকতা/অসাংবিধানিকতা সম্পর্কে রায় দেবেন।

প্রধানমন্ত্রী প্রতিরক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত বাহিনীগুলার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রধান হবেন। কোনো বাহিনীই সরাসরি তার অধীন থাকবে না। প্রতিরক্ষা বা স্বরাষ্ট্র কোন মন্ত্রণালয়ই প্রধানমন্ত্রী নিজে প্রধান হিসেবে থাকতে পারবে না। বাহিনীর ‘চেইন অব কমান্ড’ আইন ও বিধি দ্বারা সঙ্গত থাকবে। চেইন অব কমান্ডে হস্তক্ষেপ হবে অবৈধ। তবে যেকোনো কার্যের সঠিকতা সম্পর্কে জবাবদিহি থাকবে।

কোনো আদালতই প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণে রায় ঘোষণা করতে পারবেন না। কেবল সংসদ কর্তৃক আস্থাভোটই হবে তাকে অপসারণের বৈধ উপায়। সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী যেন একক কর্তৃত্ব ভোগ না করেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রী নিম্নকক্ষের প্রধান থাকবেন এবং যে কোনো পলিসি তৈরির মাধ্যমে জনগণের কল্যাণে রাষ্ট্রের কাজ করবেন। নির্বাহী বিভাগ পরিচালনা করবেন প্রধানমন্ত্রী। তবে নিয়োগের ক্ষমতা থাকবে না প্রধানমন্ত্রীর হাতে। যেকোনো নিয়োগ প্রদান করবে উচ্চকক্ষ। নিম্নকক্ষ বা প্রধানমন্ত্রীর কোনো অনুমতি লাগবে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here