উদার গণতান্ত্রিক প্রগতিবাদী রাজনীতির ভবিষ্যৎ

0
290
Bappadittya Basu-Deshinfo
Bappadittya Basu-Deshinfo

বাপ্পাদিত্য বসু: দুনিয়াজুড়ে আজ নয়া আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক মেরুকরণ শুরু হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরও দীর্ঘকাল বিশ্বে প্রগতিশীল উদার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধারা রাজত্ব করলেও আজ তা ক্রমেই পরাজিত হ। তার বিপরীতে ধর্মান্ধ, নৈরাজ্যবাদী, উগ্র ডানপন্থার উন্মেষ হচ্ছে বিশ্বের দিকে দিকে। মধ্যপ্রাচ্য তো বটেই, আমেরিকা, ইউরোপের গণ্ডি পেরিয়ে এই উগ্র ডানপন্থার ধাক্কা লাগছে দক্ষিণ এশিয়ায়, এমনকি বাংলাদেশেও। বলা যেতে পারে, আগামী অন্তত দশককালের আগে এ ঢেউ রোখার মতো পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে না।

ফলে আগামী দশক সম্ভবত হতে চলেছে বিশ্বব্যাপী ডানপন্থার দশক। এ পরাক্রমশালী ঢেউয়ের মুখে উদার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ তথা প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারার উপর প্রচন্ড আক্রমণ আসবে। আর বামপন্থা এই সময়কালে আরো বিপদগ্রস্ত হবে। আক্রমণের মূল নিশানা থাকবে তাদের দিকে তাক করা। এ বিপদ মোকাবিলা করে টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার বামপন্থার প্রস্তুতি তেমন দেখা যাচ্ছে না, এমনকি এই ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ ও বিপদের আঁচ এ অঞ্চলের বামপš’ীরা উপলব্ধিতে নিতে পারছেন কিনা তা নিয়েও সন্দিহান।

ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বিস্তারের খেলার পুতুল হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও আফ্রিকা অঞ্চলের এক বড় অংশে উগ্র সশস্ত্র ইসলামী জঙ্গিবাদের জন্ম, উত্থান ও বিকাশ হলেও আজকের দুনিয়ায় হিসাবটা আর কেবল সেখানেই সীমাবদ্ধ নেই। উগ্র সশস্ত্র ইসলামী জঙ্গিবাদ আজ নিজেই এক মহাদানবে পরিণত হয়ে দুনিয়াটাকেই গ্রাস করতে উদ্যত। কেবল মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রগুলোতেই নয়, ইউরোপ-আমেরিকাতেও ইসলামী জঙ্গিবাদ তার কালো থাবা বিস্তার করেছে বেশ আগেই। আমেরিকা-ইউরোপের রাষ্ট্রশক্তিগুলোর এ নিয়ে নানা প্রকার রাজনৈতিক খেলা থাকলেও মানুষ তো প্রকৃতপক্ষে বিরক্ত এবং সন্ত্রস্ত।

সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আর জঙ্গিবাদী মৌলবাদের এসব শান্তি-অশান্তি খেলায় মুসলিম দেশগুলোর বিরাট সংখ্যক মানুষ উদ্বাস্ত হয়েছেন, তারা অভিবাসী কিংবা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছেন ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। রাষ্ট্রপরিচয়হীন এসব মানুষ অনেকাংশেই জীবনধারণের সামগ্রিক মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত। ফলে তারা স্বভাবতই কিছু অপরাধপ্রবণতার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন।

ক্ষেত্রবিশেষে তাদের একটা অংশ ইসলামের নামে সশস্ত্র জঙ্গিবাদের সাথেও জড়িত হয়ে পড়ছে। আর এসব অপরাধ প্রবণতা কিংবা জঙ্গিবাদের ফল ভোগ করতে হচ্ছে ওইসব দেশের অমুসলিম অন্যান্য সাধারণ নাগরিকদের। ফলে তারা জ্ঞানত বা অজ্ঞানত ইসলামবিদ্বেষী হয়ে পড়ছেন। আর এই সুযোগটা কাজে লাগা”েছ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রশক্তিগুলোরই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার আরেকটা অংশ। ইসলামবিরোধী উগ্রপন্থার পাল্টা উন্মেষ হচ্ছে সেখানে। সন্ত্রাস দ্বারা আক্রান্ত অমুসলিম জনসাধারণের সাধারণ আবেগকে কাজে লাগাচ্ছে তারা।

এর মধ্য দিয়ে অভিবাসনবিরোধী, শরণার্থীবিরোধী, ইসলামবিরোধী এবং বিভক্তিবাদী আরেকটি উগ্র ডানপন্থার বিকাশ হচ্ছে, জনপ্রিয় রাজনৈতিক ধারা হিসেবে তারা দ্রুতই আত্মপ্রকাশ করছে। এসবের ফল দেখা গিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন মুলুকের নির্বাচনে, দেখা গিয়েছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানির মতো উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর নির্বাচনে। এসব দেশে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ঐক্যবিরোধী, অভিবাসনবিরোধী উগ্রপন্থীরা জয়লাভ করেছে।

উগ্রপন্থার এই ঢেউ এসে লেগেছে ভারতবর্ষেও। ভারতের চিরায়ত প্রগতিবাদী উদার গণতান্ত্রিক ধারাকে পরাজিত করে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটেছে। এমনকি কেন্দ্রের এই রাজনৈতিক স্রোত আছড়ে পড়েছে অধিকতর উদারনৈতিক বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। আসামের পর ত্রিপুরার মসনদ এখন হিন্দুত্ববাদী বিজেপির দখলে। পশ্চিমবঙ্গেও জোর নিঃশ্বাস ফেলছে তারা। পশ্চিমবঙ্গে এখন মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ। সারা ভারতেও বাড়ছে।

পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জী মুসলিম মৌলবাদী সংগঠনগুলোকে কাছে টেনেছেন, তার জোটের অংশীদার এমনকি ক্ষমতার অংশীদার করেছেন। সিদ্দিকুল্লাহ’র মতো জঙ্গিবাদী মুসলিম নেতাকে মন্ত্রী করেছেন। সন্ত্রাসবাদী ইমরান আহমেদকে লোকসভার সদস্য করেছেন। এই ইমরান-সিদ্দিকুল্লাহরা বাংলাদেশবিরোধী অপকর্মের সাথেও জড়িত, বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণের সাথে জড়িত, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী জামাত-শিবির-আনসারুল্লাহ’র আশ্রয়দাতা, এমন প্রমাণ আগেই মিলেছে।

কিন্তু মমতার তরফ থেকে কোনো রা নেই। ক্ষমতার মোহে তিনি এই জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীকে কোলে তুলেছেন। অপরদিকে তিস্তার জলের ন্যায্য হিস্যা নিয়ে বাংলাদেশের সাথে নিত্য ছলচাতুরি করছেন। তার কারণেই জলবণ্টন চুক্তি আটকে আছে। এমনকি কেন্দ্রের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারও জলবণ্টন চুক্তি করতে এক পা এগিয়েই আছে, পারছে না কেবল মমতার নির্মমতার কারণে। আর সেই মমতার আঁচলতলে ছায়া পাচ্ছে মুসলিম মৌলবাদীরা। ভারতের বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক চান। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি আপাতত যোজন যোজন দূর দিয়ে হাঁটছেন।

এসব কারণে পশ্চিমবাংলার মানুষ বিরক্ত। সেই বিরক্তিকে পুঁজি করছে বিজেপি। ত্রিপুরার বামপন্থী সরকারের বিরুদ্ধেও হিন্দুত্ববাদ আর উন্নয়নের গল্প দিয়ে মানুষকে জয় করেছে তারা। অতীতের কোনো নির্বাচনে ত্রিপুরায় কোনো আসন না পেলেও এবার তারা সরাসরি ক্ষমতায়। শতভাগ সততার মূর্ত প্রতীক কমরেড মানিক সরকার বামপš’ার ধ্বস ঠেকাতে পারেন নি। এর দুই মেয়াদ আগেই বিপর্যয়ে পড়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরাও।

গেলো নির্বাচনে সেখানে কংগ্রেস আর বামপš’ীরা মিলেও পরাজয় ঠেকাতে পারে নি। বরং কংগ্রেস সেখানে প্রধান বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে আর বামেরা আরো নিঃশেষিত হয়ে তৃতীয় দলে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতায় থাকতে সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামের কৃষকবিদ্রোহ তাদের ডুবিয়েছে। ডুবিয়েছে তাদের নিচুতলার কর্মিদের দুর্বৃত্তপনা আর নেতাদের অহংবোধও। ত্রিপুরাও দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকে একটু পা-ভারী হয়েছিলেন বৈকি তারা। আসামও উদার গণতন্ত্রীদের হাতছাড়া। সেখানে নব্য ক্ষমতাসীন বিজেপি অভিবাসী অ-অসমিয়াদের বিরুদ্ধে খগড়হস্ত হচ্ছে। বিপুলসংখ্যক আসামবাসী বাঙালির ভবিষ্যৎ সেখানে অন্ধকারের মুখে।

আসাম, ত্রিপুরা আর পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের চারপাশ ঘিরে রয়েছে। সেখানে হিন্দুত্ববাদের উত্থান বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জন্যও পাল্টা বিপদ ডেকে আনবে। ভারতের রামমন্দির-বাবরী মসজিদ বিতর্কের ঢেউয়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর কী নির্মম নির্যাতন নেমে এসেছিলো, তা নিশ্চয়ই নতুন করে মনে করিয়ে দেবার প্রয়োজন নেই।

সাতচল্লিশের ধর্মভিত্তিক দেশভাগের অব্যবহতি পরেই পূর্ববাংলা তথা আজকের বাংলাদেশের মানুষ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র আমার না। ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে সিকি শতকের গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের অন্তে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। কিন্তু ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদীরা শুরু থেকে থেমে ছিলো না এখানে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে তাদের রাষ্ট্রদখল প্রক্রিয়া শুরু হয়। অসাম্প্রদায়িক সংবিধানের প্রস্তাবনায় বসে বিসমিল্লাহ, মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা আর সমাজতন্ত্র বাতিল হয়, রাষ্ট্রধর্ম হয় ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতা এসে মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা আর সমাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনলেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল থাকলো।

ফলে মূলগত ও নীতিগতভাবে বাংলাদেশ এখন না ধর্মনিরপেক্ষ, না ধর্মতান্ত্রিক। একটি দ্বিমুখী নীতি নিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত জিততে পারে যেকোনো ধারাই। আওয়ামী লীগ এই দুই ধারাকেই সাথে নিয়ে এগোচ্ছে, তবে দিনে দিনে ডানের দিকে তার ঝোঁক বাড়ছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক সংগঠন জামাত-শিবিরকে দুর্বল করা গেলেও নিষিদ্ধ করা হয় নি। অপরদিকে পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের সর্বোতপ্রকার আশ্রয়স্থল বিএনপি দুর্বল হলেও তার বিপরীতে শূণ্যস্থানপূরণ করছে ইসলামী সাম্প্রদায়িক শক্তিই।

এই ভূমিতে প্রগতিশীল বামপন্থার প্রচন্ড সুযোগ থাকা সত্বেও ভুল নীতি ও ভুল রাজনীতির দোলাচলে তারা নিজেদেরকে বৃত্তবন্দী করে ফেলেছে কার্যত। আওয়ামী লীগ এখন ক্রমেই ডানে ঝুঁকছে। ইসলামী মৌলবাদের প্রধান প্লাটফরম হেফাজতে ইসলামের প্রায় সব দাবিই তারা একে একে মেনে নিচ্ছে। মসনদে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা টিকে না থাকলে সামনে ঘোরতর বিপদ, বিএনপি-জামাত কোনোপ্রকারে ফিরে এলেই দেশে গণহত্যা চালাবে এটা একশভাগ ঠিক। কিন্তু আওয়ামী লীগের এই ডানে ঝোঁকও বিপদ কমাবে না।

ক্ষমতার রাজনীতির হিসাবের মারপ্যাঁচে ভোটের অঙ্ক কষতে গিয়ে আওয়ামী লীগ যে ভুল করছে, তার মাশুল তো তারা একারা দেবে না, দেবে পুরো দেশ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধমুখী প্রগতিশীল কোনো রাজনৈতিক শক্তিও তো এখানে গণমুখী হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। ফলে শূন্যস্থান পূরণ করছে ইসলামী মৌলবাদীরাই। এখানেও তাই জঙ্গিবাদী উগ্রপন্থার বিপদের আশঙ্কা বাড়ছে।

দুনিয়াজুড়ে এই উগ্র ডানপন্থার ঝোঁক ও প্রবণতা আগামী দশকজুড়েই চলবেÑ একথা মোটামুটি এখনই বলে দেওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এর বিপরীতে বামপন্থার লড়াই শক্তিশালী হতে পারছে না। বিশেষ করে উপমহাদেশের, আরো নির্দিষ্ট করে বললে বাংলাদেশ-ভারতের বামপন্থীরা অধিকতর গণমুখী হতে পারছে না। বাংলাদেশে তো বামপš’ীদের প্রায় অর্ধশত সাইনবোর্ড। তাদের মধ্যে কেউ একটু বড়, তো কেউ নামকাওয়াস্তে। কিন্তু‘ বড় যারা, তারাও যে খুব একটা গণমুখী, তা নয়। সব বামেরা মিলেও মোট ভোটের এক শতাংশও টানতে পারছে না। বাংলাদেশের বামপন্থীরা মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারছেন না কেন?

চিন্তার কোনো আধুনিকায়ন তাদের নেই। মার্কসবাদের মতো একটা বৈজ্ঞানিক দর্শন ও অর্থনৈতিক নীতি-কৌশল নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়েও তারা গোঁড়ামিকে বিসর্জন দিতে পারছেন না। কার্ল মার্কস তার রচনাগুলো দুশো বছর আগে লিখে গেছেন। আজকের দুনিয়া সেই জায়গায় নেই, বহু বহু আলোকবর্ষ এগিয়ে গেছে। বোধ করি, কার্ল মার্কস এখন যদি লিখতেন, তার তত্ত্ব ও মতবাদ অনেকখানি পরিবর্তন হতো। কিন্তু এই সাধারণ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটুকু কোনোক্রমেই বাংলাদেশের বামপন্থীরা আত্মজা করতে রাজি নন।

২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার যেভাবে দেশের তরুণদের মনোজগত ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করলো, বামপš’ীরা এমনকি আওয়ামী লীগের জোটে থাকা বামপন্থীদের নির্বাচনী ইশতেহারও তরুণদের আকৃষ্ট করতে পারলো না। তরুণপ্রাণের সংখ্যা বামপন্থীদের দিকে ক্রমেই কমছে। আপামর কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের রাজনীতি করলেও লাল পতাকার মিছিলে দিনে দিনে তাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে কেন, এসব কারণ বিশ্লেষণের কোনো প্রয়োজন বামপন্থীরা মনে করেন নি। তারা মার্কসবাদী তত্ত্ব ও কর্মসূচির সময়ানুকরণ করতে পারেন নি। সত্তর বছরের পুরনো গৎবাঁধা কিছু স্লোগান মানুষকে আর আকৃষ্ট করতে পারছে না। ক্ষমতায় গেলে বামপন্থীদের সার্বিক রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি ও কর্মসূচি কী হবে সে সম্পর্কে কোনো পরিষ্কার অবস্থান কার্যত নেই।

বাংলাদেশের বামপন্থীরা মাঝে মাঝে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে সেদেশে বেড়াতে যান। সেখান থেকে ফিরে চীনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ঝরে তাদের মুখে ও কলমে। কিন্তু মার্কসবাদের খলনলচে পাল্টে দিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করে একটা পুঁজিবাদী ও কর্পোরেট অর্থনীতিকে আঁকড়ে ধরেও কীভাবে চীন তার জনগণের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করছেন সেই তত্ত্ব ও কর্মসূচিকে আত্মস্ত করতে বিন্দুমাত্র চেষ্টা বাংলাদেশের বামপন্থীদের নেই।

লাতিন আমেরিকার বামপন্থীরা ট্র্যাডিশনাল কমিউনিস্ট পার্টি না হওয়া সত্বেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দৌর্দণ্ড প্রতাপে লড়াই করে তাদের নিজ নিজ দেশের জনগণের সর্বোচ্চ কল্যাণ কীভাবে নিশ্চিত করছে, সে সম্পর্কে কোনো গবেষণা বা তত্ত্বের নির্মাণ এখানে বামপন্থীদের নেই। আজকের দুনিয়ায় সত্যিই আর ভাবার অবকাশ নেই যে বিড়াল কালো না সাদা। ভাবতে হবে বিড়ালটি ইঁদুর মারছে কিনা।

এই ভাবনা, তত্ত্ব ও কর্মসূচির আধুনিকায়ন ছাড়া কোনোভাবেই দুশো বছরের পুরনো গ্রন্থগত বিদ্যা আর সত্তর বছরের পুরনো স্লোগান দিয়ে আর মানুষকে আকৃষ্ট করা যাবে না। ত্রিপুরার কমরেড মানিক সরকার শতভাগ সততার মূর্ত প্রতীক হওয়া সত্বেও মানুষকে ধরে রাখতে পারেন নি বামপন্থার পাশে। নির্বাচনে ডাব্বা খেয়ে কেবলমাত্র কালোটাকার কাছে হেরে গেলাম বলার অর্থ হলো জনগণ ও ভোটারদের অপমান করা, নিজেদের আত্মমূল্যায়ন ও আত্মউপলব্ধিটা কোথায়?

বাংলাদেশের বামপন্থার আরো একটি প্রধান সঙ্কট হলো জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে ধরতে না পারা। একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের সূত্র ধরতে না পারলে ওই জনগোষ্ঠীর আবেগ এবং রাজনৈতিক অভিপ্রায়কে তো ধরা যাবে না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর এ ভুলটি সচেতন বা অবচেতনভাবে বাংলাদেশের বামপন্থীরা করেছেন। একটা বিরাট অংশ সে সময় সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে হাজার হাজার জীবনদান করলেও কিছু অংশের দুই কুকুরের কামড়াকাড়ির তত্ত্ব সামনে এনে সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে বিরত থাকা, সত্তরের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সরকারকে সহায়তা না করা, স্বাধীন দেশেও দীর্ঘ বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানভিত্তিক রণনীতি ও রণকৌশল আঁকড়ে থেকে পূর্ব পাকিস্তানের নামেই রাজনীতি ও সংগঠন অব্যাহত রাখা, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে ক্ষেত্রবিশেষে সমর্থন করে আওয়ামী লীগ বিরোধী তথা পাকিস্তানপন্থী সামরিক-রাজনৈতিক শক্তির সাথে আপোস করা ইত্যাদি ভুলের রাজনীতি বাংলাদেশের বামপন্থীদেরকে মানুষ থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করেছে।

আজকের দিনেও যে বামপন্থীরা মুক্তিযুদ্ধমুখী প্রগতিবাদী উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে গণমুখী শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারতো, তখনও ক্রমাগত ভুলের বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। একটি অংশ আওয়ামী লীগের জোটভুক্ত হয়ে নিজেদের গণমুখী রাজনীতি আর নিজস্ব সংগঠনকে ভুলে থেকে আত্মবিসর্জনের পথে হাঁটছে। তাদেরও নিচুতলায় দুর্বৃত্তপনা আর উপরতলায় অহংবোধ গ্রাস করেছে। আরেকটি অংশ আওয়ামী বিরোধিতার নামে গণমুখী পথ আঁকড়ে না ধরে বিএনপিপন্থী রাজনীতিতে মজে রয়েছে। বহুদলীয় গণতন্ত্র বলতে তারা স্বাধীনতাবিরোধীদেরও রাজনৈতিক ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ বোঝে, বাকস্বাধীনতা বলতে তারা পাকিস্তানপন্থীদেরও অবাধ সুযোগের পথ বোঝে।

সর্বশেষ সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণ আন্দোলনের নামে একটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনে তাদের সমর্থন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ তাদের সেই ভুল রাজনীতিকে আরো দীর্ঘায়িত করলো। অথচ মুক্তিযুদ্ধ এবং ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি আর বৈষম্যহীন কল্যাণ অর্থনীতিকে এই ভূমির সমাজতন্ত্রের মূলমন্ত্র হিসেবে ধারণ করে পাকিস্তানপন্থী সামরিকতন্ত্রী রাজনৈতিক দলগুলোর কঠোর বিরোধী অবস্থানে থেকে মানুষের অন্তরের কাছাকাছি বামপন্থীরা থাকতে পারলে এই ভূমিতে অন্তত ইসলামী উগ্র ডানপন্থার উন্মেষ হতো না। গণতন্ত্রের শূন্যস্থানও তারাই পূরণ করতে সক্ষম হতো।

দুনিয়াজুড়ে উগ্র ডানপন্থার এই উন্মেষকালেও বাংলাদেশের প্রগতিবাদী উদার কোমল জমিনে বামপন্থার সঠিক রাজনৈতিক লাইন গ্রহণ এবং মার্কসবাদী তত্ত্ব ও কর্মসূচির পুনর্নির্মাণ পারতো এ ভূমিকে রক্ষা করতে। কিন্তু আপাতত সে সম্ভাবনা আর দেখা যাচ্ছে না। ফলে ক্ষমতার রাজনীতি ছাড়া কিছুই এখানে আর অবশিষ্ট রইলো না। সেই ক্ষমতার অঙ্কে আওয়ামী লীগের ডানে মোড় যতোটা সম্ভব পাহারা দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা ছাড়া বাংলাদেশের জনগণের আর কীই বা করার আছে? অথচ বামপš’ার সঠিক পুনর্নির্মাণই পারতো এখানে উদার গণতান্ত্রিক প্রগতিবাদী কল্যাণ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবর নতুন রূপ সৃষ্টি করতে!

লেখক : প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here