চায়ের কাপে তুফান (২)

0
387
Motahar Hosshain-Deshinfo
Motahar Hosshain-Deshinfo

মোতাহার হোসেন: আবার চায়ের আড্ডায়। স্থান সেই আমজাদ হাটের তারুর চায়ের দোকান। আজকের বিতর্কের বিষয় চেয়ারম্যান না। আজ তর্ক হচ্ছিল ঘাতক বাস নিয়ে। আজও আবলু আর ফজলু সরব। আবলু বলতে থাকে, বুঝবে ব্যাটা ড্রাইভাররা, সব গণমাধ্যম যেভাবে সোচ্চার! ব্যাটাদের নির্ঘাত ফাঁসি হবে। কচু হবে, কিচ্ছু হবে না, ফজলুর কড়া জবাব। খরবতো রাখো না কিছু! জামিন দেয়া শুরু হয়ে গেছে।

এর মধ্যে চার পাঁচজন জামিনে বেড়িয়েও এসেছে। বাকিদেরও জামিন হয়ে এলো বলে, ফজলু বলল। আবলু বিরক্তির সুরে বলল, এতগুলো মানুষ মেরে ফেলল। কারো হাত কারো পা নিয়ে গেল, আসামীরা ধরাও পরল, আর তুমি বলছো কিচ্ছু হবে না। সব ছাড়া পেয়ে যাবে, এরকম হয় নাকি? এটা কি মগের মুল্লুক? দেশে আইন আদালত নাই? কোট কাচারি পুলিশ এসব কিসের জন্য। ফজলু: মগের মুল্লুকই। মগের মুল্লুক যে তা ড্রাইভাররাও জানে। মানুষ মারলে কিংবা ধর্ষণ করলে, কুচ পরোয়া নেহি। কিচ্ছু হবে না।

সরকারি দলের অনেক মন্ত্রী এমপি, প্রভাবশালী নেতারা ড্রাইভারদের পেছনে আছে। তাই তারা পুলিশ মারতেও ভয় পায় না। শুনোনি, পুলিশ একটার কি হাল করেছে!

প্রতিদিনের মত আজকেও আবার দোকানে আসে রবিউল উকিল। উকিল সাহেবকে দেখে চায়ের কাপে তুফানওয়ালারা ঘটনার বৃত্তান্ত শুনতে চায়। উকিল মানুষ আইনের কথা বলবে। গ্রামবাসী রবিউলের কাছে জানতে চায়, আসামীদের নাকি জামিন হয়েছে! জামিন হলো ক্যামনে? কারো কারো নাকি কোন বিচারই হইব না! রবিউল গ্রামবাসীকে সহজ ভাষায় আইনের কিছু বলার চেষ্টা করে। কারণ গ্রামবাসীর তার উপর পূর্ণ আস্থা আছে। উকিল বলতে থাকে; দেখ, জজ সাহেব ইচ্ছা করলেই কারো যাবজ্জীবন কিংবা ফাঁসি দিতে পারে না। বিচার করতে হয় আইনের ধারা, উপধারা বিশ্লেষণ করে, সে মোতাবেক, নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্য থেকে।

এখানে হত্যাগুলো হয়েছে, হত্যা বলো আর এক্সিডেন্ট বলো, যেভাবেই বলো না কেন, দেখতে হবে কোন ধারায় মামলা হয়েছে। এবং বাদীপক্ষ কি বলছে, মামলাগুলো কোন কোন ধারায় চলছে, ইত্যাদি। দোকানের উপবিষ্টরা প্রায় একই সাথে বলে, আমরা অপরাধীদের শাস্তি চাই, হয় ফাঁসি না হয় যাবজ্জীবন। সেখানে ওরা সহজেই জামিন পেয়ে যাচ্ছে, তাহলে আমরা কার কাছে কিসের বিচার আশা করব।

রবিউল বলে, সে কথাই তো বলছি। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে যারা মারা গেছেন বা মারাত্মক আহত হয়েছেন, তন্মধ্যে মাত্র একটি মামলায় হত্যা চেষ্টার কথা বলা হয়েছে। তাও ভিক্টিম পুলিশ বলে। নচেৎ এটাও আট দশটি মামলার মত জামিনযোগ্য মামলা হত। ঢাকা পলাশীর মোড়ে ট্রাফিক ইন্সপেক্টর দেলওয়ার কে যে ড্রাইভার ইচ্ছাকৃত ভাবে চাপা দিয়েছিল, সেই মামলাটি হয়েছে জামিন অযোগ্য ৩০৭ ধারায়।

আয়েশা খাতুন দুই বাসের রেসারেসিতে মারত্মক ভাবে আহত হওয়ার পর তার শরীরের নিচের অংশ অবশ হয়ে যায়। এখন সিআরপি-তে চিকিৎসাধীন আছে। অন্যদিক বাস ড্রাইভার জামিন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আয়েশা হাসপাতালে শুয়ে আছে, কবে বাড়ি যাবে, বা আদৌ যেতে পারবে কিনা, গেলেও চলাফেরা করতে পারবে কিনা, একেবারেই অনিশ্চিত। ড্রাইভার নিশ্চিন্তে আছে।

কয়েকদিন পর আবার বাসে উঠবে আরেকজনকে চাপা দিবে। এর কারণ, মামলাটি ছিল জামিনযোগ্য। মাঝখান দিলে ফজলু বলে, কোন মুল্লুকে আমরা বাস করছি। আড্ডারতরা অন্যান্য মামলা সম্পর্কে উকিলের কাছে জানতে চাইলে, উকিল বলে, প্রায় সবগুলোর অবস্থা একই। রোজিনা, খালিদ, রুনি আক্তার সব কয়টি মামলাই ‘জামিনযোগ্য’। এমনকি যে রাজীব হোসেনকে নিয়ে এত লেখালেখি হয়েছে, সে রাজীব হত্যার মামলাটিও হয়েছে, ৩০৪ ধারায়।

অন্যান্য গুলোর অবস্থা তো আরো খারাপ। রোজিনারটা হয়েছে, ২৭৯, ৩৩৮ ধারায়। খালিদেরটা হয়েছে ২৭৯, ৩৩৮। রুনিরটাও একই ধারায়। সবগুলোই জামিনযোগ্য! গ্রামবাসীর মধ্যে কিছুটা উত্তেজনা বিরাজ করে। তারা প্রায় সমস্বরেই বলতে থাকে, এইরুপ খামখেয়ালি আইন করার কারণ কি! রবির উত্তর, কারণ ড্রাইভার হেল্পারদের শ্রমিক সংগঠন। এ শ্রমিক ফেডারেশান খুবই শক্তিশালী; দৈনিক লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা উঠে। নেতৃত্বে থাকেন, ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী এমপি অথবা প্রভাবশালী নেতারা। এটা হয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে, সব সরকারের আমলে। হোমরা চোমরারা ফেডারেশানের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়।

একারণে, যাবজ্জীবন থেকে প্রথমে নামিয়ে আনা হয় দশ বছরে, এটা কমতে কমতে বর্তমানে তিন বছরে এসে ঠেকেছে। ধারাগুলো দিন দিন দূর্বল থেকে দূর্বলতর হচ্ছে। এরপর হয়তো দাবী উঠবে, মামলাই করা যাবে না। আবলু জানতে চায়, এর থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই? উকিল, আছে; এজন্য আইনের সংস্কার করতে হবে; আলাদা কোর্ট করতে হবে; আইন প্রয়োগে স্বচ্ছতা আনতে হবে; ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হতে হবে; ড্রাইভার হেল্পারদের মানবিক মূল্যবোধের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ড্রাইভারদের কর্মঘন্টা আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী আট ঘন্টায় সীমিত করতে হবে।

তিনদিন ডিউটি করা, তিনদিন ঘুরে বেড়ানো বন্ধ করতে হবে। একটা লোক একটানা ষোল ঘন্টা ডিইউটি করলে তার মগজ কুকুরে মগজের মত হয়ে যায়; তার কাছে মানবিক আচরণ প্রত্যাশা করা আহম্মকি। সব শেষে, মাননীয় প্রধাণমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ জরুরী।
.
লেখক: মোতাহার হোসেন‌, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, সাবেক পরিচালক বিআইডব্লিউটিএ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here