শ্রীকৃষ্ণপুত্র শাম্ব’র কুষ্ট রোগ ও বারাংগনা প্রসঙ্গঃ (পর্ব ৬)

0
660
Motahar Hosshain Write up about Loard Krishna son Shambu-Deshinfo
Motahar Hosshain Write up about Loard Krishna son Shambu-Deshinfo

মোতাহার হোসেন: শুধু দারকা নগরীতে নয়, ত্রিভুবনে স্বর্গ মত্ত ও পাতালপুরীতে শশ্মানের নীরবতা নেমে আসে। অতি সুন্দর শাম্বর আসন্ন কুষ্ঠ রোগ ভাবনায় সবাই বিমর্ষ; বেদনায় ভারাক্রান্ত। হায়রে এমন সুপুরুষ, তার এমনি পরিনতি!

কৃষ্ণের চোখে মুখে কোথায় কোন রূপ ক্রোধের চিহ্নমাত্র নেই। কৃষ্ণ বলতে থাকেন, শাম্ব একমাত্র অভিশাপ দিয়েই যদি সকল সংকট নিরসন হত তাহলে আমাকে যুদ্ধ করে শত্রু নিধন করতে হত না। তুমি তো জানো আমি যে রথে যেতাম, রথের সারথি সে রথে অস্ত্র বোঝাই করে রাখত, প্রয়োজনে শত্রু নিধনের জন্য।

দেবতাদের অভিশাপ কেবলমাত্র মনকষ্ট থেকে উচ্চারিত হয় না। দেবতাদের অভিশাপ সাধারণের মত না। আমি শ্রীকৃষ্ণ, আমি বাসুদেব, আমি জনার্ধন, আমি ভগবান। আমার অভিশাপ সাধারণের ন্যায় হয় না। যা ভবিতব্য, যা ঘটবে, যা অনিবার্য তাই অভিশাপ হয়ে আমার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়, হয়েছে মাত্র। আমি দিব্যচোখ দিয়ে দেখলাম; তোমার জন্মলগ্নেই এই কুৎসিত ব্যাধি তোমার ভাগ্যে লেখা হয়ে গেছে, আমি অতি ক্রোধে তা উচ্চারণ করেছি মাত্র। তোমার কুস্টি অনুযায়ী তোমার এ রোগ প্রকাশের সময় আসন্ন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এ রোগে তুমি আক্রান্ত হবে। রক্তবর্ণ ফুলের ন্যায় তোমার দেহের রং ধারণ, অঙ্গপ্রতঙ্গের স্ফীতি; কিছুই স্বাভাবিক নাই। এগুলো তোমার কালব্যাধির পূর্বলক্ষণ মাত্র।

আমি স্বীকার করছি, তোমাকে দেখে, রমণীদের যৌণ ইচ্ছাই আমাকে ক্ষুব্ধ করেছে। তাই অভিশাপ দিয়েছি। শাম্ব এবার অনেকটা হতাশার স্বরে জিজ্ঞাস করল; তাহলে বলুন পিতা, এরোগ থেকে আরোগ্য লাভের উপায় কি?

ধ্যানমগ্ন হলেন বাসুদেব, ধ্যানে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন; নারদ, মহর্ষী নারদ। নারদকে তুমি ক্ষেপিয়েছ। তুমি তাকে যথেষ্ট সম্মান করো নি। তুমি রমণী সংস্পর্শ পেয়ে বিভোর ছিলে। ভুলে গিয়েছিলে নারদের ক্ষমতা সম্পর্কে। আমার মনে হয়, তোমার নারদের কাছে যাওয়া উচিত। তার ত্রিভুবনের সর্বত্র গমন, মত্তের সকল স্থান নখদর্পনে। বহুবিচিত্র জাতি, স্থান, সম্প্রদায় তিনি চাক্ষুষ করেছেন। অভিজ্ঞতা আমাদের থেকে অনেক বেশী, ব্যাপক, একমাত্র তিনিই পারেন, তোমাকে সঠিক পথ দেখাতে, আমার ধারণা মহর্ষীও তাই চান। তুমি তার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ো। শাম্বর এবার যাওয়ার পালা। পিতার পদধূলি মাথায় ঠেকিয়ে, শাম্ব তাকালেন মায়ের দিকে, জান্ববতী। মা জান্ববতী তখন কাঁদছিলেন।কাছে গিয়ে শাম্ব মাকে প্রণাম করলেন; রুক্ষিনী ও সত্যব্যামাকেও প্রণাম করলেন। ক্রন্দনরত জান্ববতী বললেন; আশীর্বাধ করি বৎস, তুমি শাপ মুক্ত হও। তোমার রমণীমোহন রূপ আবার ফিরে পাও।

সহস্র সহস্র গোপীনিগণ কাঁদছিল। যেন সমগ্র দারকা নগরীর গাছপালাও কাঁদছিল। কাঁদো দারকা নগরী কাঁদো। আজ তো কান্নারই দিন। শাম্ব প্রমোদকাণন থেকে নগরীর উদ্দেশ্যে বিদায় নিলেন। নগরীতে প্রবেশের সময়, তাকে আত্মমগ্ন দেখাচ্ছিল, ভাবছিল রোগমুক্তির কথা। যে সব রমণীরা নগরীতে তার জন্য অপেক্ষায় ছিল, শাম্ব সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সরাসরি চলে যান তার নিজ গৃহে। গৃহে ঢুকেই তিনি দরজা বন্ধ করে দেন। গৃহমধ্যে, লক্ষ মুদ্রার হীরার জহরত, মনিমুক্তা, সূবর্ণসজ্জ্বা, কোন কিছুর প্রতি ভ্রক্ষেপ নাই। দৃষ্টিপাত মাত্র করলেন না, এসব দামী জমকালো সামগ্রীর দিকে। সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন অতিকায় সূবর্ণ দর্পণের সামনে, নিজেকে দেখার জন্য। ব্যাধির কোন চিহ্ন চোখে পরে কিনা! না, পিতা বাসুদেব মিথ্যা বলেন নি, আয়নায়(দর্পন) ভালভাবে তাকালে বুঝা যায়; নাক, কান এবং ভ্রুসহ কোন কোন স্থান কিছুটা স্ফীত। মনে মনে বলেন, এখনি বেড়িয়ে পরতে হবে। কারো নজরে আসার আগেই।

দর্পন থেকে সরে এসে দরজা খুলে দিলেন হতভাগ্য শাম্ব। রমণীদের মধ্যে কেবল লক্ষণা, শাম্ব স্ত্রী। সর্বাঙ্গ সুন্দরী লক্ষণা দূর্যোধনের ভগিনী, যাকে শাম্ব হরণ করে বিবাহ করেছিল। এক মাত্র লক্ষণাকেই ঘরে ঢুকতে দেয়া হয়। প্রিয়তমা লক্ষণা, শাম্বর অনেক সহচরী থাকলেও শাম্বর হৃদয়ের রাণী ছিল লক্ষণাই। স্বামীর বিমর্ষ চেহারা দেখে, লক্ষণার হৃদয় অশুভ আশংকায় কেঁপে উঠল। জানতে চাইল কি হয়েছে। এমন দেখাচ্ছে কেন? শাম্ব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। বলেন, কেমন দেখাচ্ছে আমাকে লক্ষণা? লক্ষণাকে শাম্ব সব কথাই খুলে বলেন। লক্ষণা আর্তনাদ করে উঠল, অভিশাপ! কেন?

তুমি রমণীমোহন একথা সবাই জানে, একি তোমার অপরাধ! তবে কেন অভিশাপ? শাম্ব বলে, লক্ষণা, এ আমার ভাগ্যের পরিহাস। আমি এখন থেকে, তোমাকে ছেড়ে, তোমাদের ছেড়ে আলাদা থাকব। একান্ত একা। নগরীর বাইরে, কোন এক নির্জন স্থানে, মহর্ষী নারদের সাথে সাক্ষাৎ করে তার নির্দেশ নেব। তিনি যাই বলেন, তাই করব। এছাড়া আর কোন পথ নাই।

লক্ষণা স্বামীকে কিছুতেই যেতে দেবে না। কুষ্ঠব্যাধি হলেও স্বামীর সেবা করবে, না হয়, লক্ষণাকে সাথে নিয়ে যেতে হবে, আমি তোমার সাথেই যাব। শাম্ব বলে, লক্ষণা, মহর্ষীর সাথে দেখা হওয়ার পর, উনি চাইলে, তবে মাত্র তোমাকে নেয়া যাবে। মনে হচ্ছে দ্রুত আমাকে ব্যাধি গ্রাস করবে। পূর্ণগ্রাসের পূর্ব পর্যন্ত, নগরীর বাইরে কোথাও একাকী থাকব। তারপর মহর্ষীর সন্ধানে বেড়িয়ে পড়ব।
চলবে…

লেখক: মোতাহার হোসেন‌, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, সাবেক পরিচালক বিআইডব্লিউটিএ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here