রুম নাম্বার ১৪৬ (২)

0
601
Showkat Ahsan Farugue-Dehinfo
Showkat Ahsan Farugue-Deshinfo

শওকত আহসান ফারুক: আমি রসায়ন বিষয় নিয়ে পড়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বেড়ে উঠা কুমিল্লা শহরে, শৈশব কেটেছে জন্মভুমি হাটখোলা কুমিল্লা গ্রামের বাড়িতে। পিতা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের রসায়নের শিক্ষক সেই সুবাদে, কুমিল্লায় স্কুল জীবন শুরু। শহর ও গ্রামের রসায়ন নিয়ে গড়েছি নিজের জীবন। ব্যক্তিগত জীবনে দুই ছেলে এক মেয়ের জনক। এখন আবসর জীবন যাপন করছি। পঁয়ষট্টি বৎসরের জীবনে ফিরে দেখা অতীত ও ঐতিহ্য নিয়ে লিখেছি, ‘যে স্মৃতি ধূসর হয়নি’, যে স্মৃতি।’ বর্তমানে লিখছি, রুম নাম্বার ১৪৬। সেটিকেই এখানে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।

(৪)
শাগবাগ বিপণী বিতান বেশ জমে গেছে। সব ধরনের দোকান আছে, গ্যানজেস, সিনোরিটা, মৌলি, শুভ্র প্রশুণ।, আলকেমি,জিরাজ আর্ট গ্যালারী, সুন্দর সুন্দর নাম নিয়ে কতগুলো দেকান,জমজমাট। ভালো কিছু কিনতে চাও শাহবাগে যাও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সবাই শাহবাগে আসেন নিয়মিত, সিনোরিটা পাশে বসার জাগগাটা, আহা!

আমি ঢাকায় এলে শাহবাগে উঠি, রাগীবের বাসায়, জ্যাঠা গেজেটেড অফিসার্স ট্রেনিং একাডেমীর প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ভিতরে কোয়ারর্টার, কিছু বাড়তি সুবিধা ছিলো, শুধু ট্রেনিং চলাকালীন সময় উপরের হোস্টেলে ট্রেনিরা থাকে, বাকী সময় খালি পড়ে থাকে, কুমিল্লা থেকে আমার সাথে সর্বদাই কেউ না কেউ আসে পার্টির কাজে, অনায়াসেই হোস্টেলে থেকেছি, দারুণ পরিপাটি ছিলো একাডেমী হোস্টেল।

১৯৬৯ সাল থেকে ছাত্রলীগ রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়ার পর, কোন না কোন কাজে ঢাকায় নিয়মিত আসা যাওয়া, কখনো ডেলিগেট, কখনো লিটল ম্যাগের ব্লক করতে। স্কুলে থাকতে বেড়াতে এসেছি, এখন আসি কোন না কোন কাজে।

শাহবাগেই আড্ডা, রাগীব ১৯৭০ সালে মাধ্যমিক পাশ করে ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজে ভর্তি হয়েছে, তবে পদার্থ বিদ্যা, রসায়নের চাইতে আকা ঝুকিতে আগ্রহ বেশী, শিখেছে রঙ রসায়ন, শাগবাগ বিপণী বিতানের লাগায়া পশ্চিমে ৮ ফুট বাই ১০ ফুট একটা টিনের একচালা নিয়ে ‘রেখায়ন’ নাম দিয়ে বসে গেলেন, পাশে দুইটা হোটেল, একটা গ্যারাজ, একটা মুদি দোকান,একটা ঔষধের দোকান, এই ছিলো সেদিনের শাহবাগের চালচিত্র।

সদ্য স্বাধীন দেশ, বধ্য ভুমিতে সব দোকানের সাইন বোর্ড ইংরাজি ও উর্দুতে লেখা হয়েছিলো, এবার এলো বদলের পালা, তাই রঙতুলি চালানো পেইন্টারের ভীষণ কদর।

সাইন বোর্ড, গাড়ির নাম্বার প্লেইট সবই পাল্টাতে হচ্ছে, রাগীবকে আর পায় কে, রেখায়ন খুললেই একটা না একটা কাজ, হাতে কাঁচা পয়সা, নেশায় পেয়ে গেলো শখ করে শিখেছিলো রঙের কাজ, এখন হয়ে গেলো পেশা।

ঢাকায় এসেছি ভার্সিটিতে ভর্তি হতে, সময় ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময়ে, সৈয়দ আহম্মদ ফারুক, সৈয়দ রেজাউর রহমান, মনিরুল হক চৌধুরী মতিঝিল দিলকুশায় আদমজী কোর্টে অফিস নিয়েছে।

সাপ্তাহিক বাংলাদেশ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে সেখান থেকে, এই পত্রিকা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারত থেকে প্রকাশিত হয়েছে, নিয়মিত।
কুমিল্লা থেকে তারেক এসে এখন ঢাকায়, আজিমপুরে কলোনির ৫৩/এ, তে।থাকে, ঘুম থেকে উঠেই রেখায়নে চলে আসে।
সাপ্তাহিক বাঙলা দেশ’ পত্রিকার সাহিত্যের পাতা দেখশুনা করে, আমাদের ও হয়ে গেলো আদমজী কোর্টে নিয়মিত আড্ডা, লোলিটা বিজ্ঞাপণি সংস্থা নামেও একটা প্রতিষ্ঠান ছিলো সাথে।

এভাবেই ঢাকার সাথে সম্পৃক্ততা, ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেলো।

৫.

সেদিন শাহবাগ এমন ছিলো না, বেশ ছিমছাম, ‘হোটেল শাহবাগ’ বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর হলো, এক সময় এটাই ছিলো শহরের প্রধান হোটেল, বট ও অশ্বত্থ বৃক্ষের ছায়ায় বিশাল অট্টালিকায় মনোরম একটি হোটেল। বইয়ে পড়েছি ঢাকার দর্শনীয় স্থান শাহবাগ হোটেলের নাম।
শাহবাগ হোটেল, ছিল ঢাকার প্রথম তিন তারকা হোটেল। হোটেলটির স্থপতি ইংরেজ এডোয়ার্ড হাইক্স ও নকশা করেছিলেন রোনাল্ড ম্যাককেনেল। হোটেলের অবস্থান ছিল শাহবাগ মোড়ে বর্তমান পুবালি ব্যাংকের পেছনে। পূবালী ব্যাংকের ভবনটি সে সময় ‘মুসলিম লীগের’ কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায়, নবাবরা উনিশ শতকে বেশকিছু ভবন মনোরঞ্জনের জন্য তৈরি করেন, যেখানে বাইজি নাচ হতো। এরকমই একটি উল্লেখযোগ্য বাইজি ঘর ছিল ‘ইসরাত মঞ্জিল’। পিয়ারী বাই, ওয়ামু বাই, আবেদী বাইয়ের মতো বিখ্যাত বাইজিরা এখানে নাচতেন। নবাব সলিমুল্লাহ ১৯০৬ সালে ভবনটি নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের স্থান হিসেবে নির্বাচন করেন, এই ভবনেই ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তিতে এটিকে সংস্কার করে, হোটেলে রূপান্তরিত হয় হোটেল শাহবাগ, ঢাকার প্রথম আন্তর্জাতিক হোটেল।

চিত্রালী পড়ে জেনেছি, নায়ক রহমান শাহবাগ হোটেলে কর্মরত ছিলেন, একদিন চিত্র নির্মাতা এহ্তেশামের নজরে আসেন, দেখে পছন্দ হয়ে যায়, সিনেমার নায়ক করার প্রস্তাব দেন সেই ‘৬২ /৬৩ সালের কথা অতঃপর সবার জানা, জনপ্রিয় সব সিমেমার নায়ক রহমান।

শাহবাগ হোটেল থাকাকালীন সময়ে আমিও গিয়েছি, ‘হোটেল শাহবাগ’ দেখতে, ছবির মতো মনে আছে গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালি ছাওয়া, হোটেল শাহবাগ, একটা ঝর্ণা ছিলো সামনে, সিনেমায়ও দেখেছি।

হোটেলের প্রবেশ পথে, একটা বিরাট অশ্বত্থ ছায়া বিছিয়ে রেখেছে, ক্লান্ত পথিক একটু জিরায় এখানে। ঢাকার যেখানে বট অথবা অশ্বত্থ, সেখানে চলে সাধু সন্ন্যাসী ও সিদ্ধির আড্ডা, একতারা, ডুগডুগি, কুপির আলোয় চলে দেহতত্ত্ব মারফতি গান, সেই অশ্বত্থ গাছটা ভীষণ মনে পড়ছে, ঝুরি মূল মেলেছে শিকড় হৃদয় মৃত্তিকাতে।

ডঃ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম স্যারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়, প্রধান মন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, শাহবাগ হোটেলে পিজি হাসপাতালকে এই রূপে আনেন।
শাহবাগ বিপনী বিতান ছিলো কনভেনশন মুসলিম লীগের আয়ের একটা প্রকল্প, নীচে মার্কেট উপরে অডিটোরিয়াম সহ আনুসাঙ্গিক অনেক কিছু। পরে এটা পিজি হাসপাতালের দখলে চলে আসে।

অবস্থান বিবেচনায় শাহবাগ তখন ঢাকার রাজধানী। দক্ষিণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রেসকোর্স। পূর্ব দিকে বাংলাদেশ বেতার, হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল, ঢাকা ক্লাব, রমনা সব মিলে জায়গাটা খুব রমনীয়। পশ্চিমে হাতিরপুল, পুরানো রেল লাইন তখনো রাস্তা হয়নি, লাইনের উপর ব্রিজটা তখনো ছিলো। কিছু কেনা কাটা করতে, আমাদের হাতিরপুল যেতে হতো, পরীবাগের রাস্তা ধরে।

আমি আর তারেক কুমিল্লা থেকেই হরি হর আত্মা, ঢাকায় এসে পেলাম পূর্ণ স্বাধীনতা, তারেক উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে এসেছে, কোথাও ভর্তি হবে, ফারুক ভাইয়ের পত্রিকায় সাহিত্যের পাতা দেখে, এটা হয়ে গেলো, ‘আমরা জ্যোস্নার প্রতিবেশী’র’ সাহিত্যের পাতা।

আমাদের নিয়মিত গল্প কবিতা ছাপার একটা ব্যবস্থা হয়ে গেলো।

রানু ভাবী এখন ফকিরা পুলে, ইনার সার্কুলার রোডে থাকে, কুমিল্লার কিছু কিছু ভালোলাগা সাথে করে নিয়ে এসেছি, যেমন রানু ভাবী, টেলিফোন করে প্রায়ই চলে যাই আমি ও তারেক দু’জনে।

ঢাকা এখন প্রাদেশিক রাজধানী থেকে দেশের রাজধানী, এমনই একটা সূচনা লগ্নে, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ঢাকায় আসি।

৬.

কমলাপুর রেলওয়ে ষ্টেশন হবার আগে, যখন ঢাকা এসেছি তখন ট্রেন তেজগাঁও হয়ে কমলাপুর না যেয়ে হাতির পুল, নীলক্ষেত, পলাশী হয়ে ফুলবাড়িয়া ষ্টেশন পৌঁছাতো। ফুলবাড়িয়াই ছিলো ঢাকার প্রধান ষ্টেশন, এখন ঢাকাকে আমরা কমলাপুর নামেই জানি। একটা মজার ব্যাপার, শহরে রেল লাইনের দু’পাশের দৃশ্য, সব জায়গায় প্রায় একই রকম, যেন পিঠ দিয়ে আছে উল্টা হয়ে, একই আদলে বানানো লাল দালান, টিনসেড টি-স্টল, হকার, লাল পোশাকে কুলি, বড় বড় ষ্টেশনে রয়েছে একটা ফুট ওভার ব্রিজ, একই রকম প্ল্যাটফর্ম, সব ষ্টেশনের চেহারার রয়েছে যথেষ্ট মিল।

তবে জংশন এলে বুঝাযায় একটু অন্যরকম, খুব ভালো করে দেখতে হয় এটা কোন ষ্টেশন। ঢাকা শহরে ছিলো কয়েকটি ষ্টেশন ক্যান্টনমেন্ট, বনানী, তেজগাঁও, ফুলবাড়িয়া, গেন্ডারিয়া তারপর ফতুল্লা পাগলা হয়ে, নারায়নগঞ্জ শেষ ঠিকানা।

তেজগাঁও থেকে দয়াগঞ্জ, রেলপথ তুলে নিলে পথটা বিরান হয়ে গেলো, একসময় স্লিপার গুলো উঠিয়ে নিলো। আশে পাশের গলিপথ গুলো যেন প্রাণ পেলো, পিঠ উল্টিয়ে বুকে টেনে নিলো পথটাকে সহসাই, নতুন বিন্যাস।

কাঁঠালবাগান, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, ভূতের গলি, এ্যালিফেন্ট রোড, নিমতলী, বক্সি বাজার একে একে সব পাল্টে গেলো। জায়গা জমির দাম বেড়ে গেলে, নতুন স্থাপনা গড়ে উঠলো, রাজধানীর রূপ পাল্টে যাচ্ছে দিন দিন। আগে ট্রেন হাতিরপুল এলেই বুঝতাম এসে গেছি ঢাকা।

ঢাকার সাথে হাতির যোগাযোগ অনেক প্রচীন। পিলখানা, এলিফ্যান্ট রোড, হাতিরপুল, হাতির ঝিল, হাতির ঘাট, মাহুতটুলি, নামগুলো থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, একসময়, ঢাকা নগরীর সঙ্গে হাতির ছিলো বেশ নিবিড় সম্পর্ক।

ব্রিটিশ আমলে ঢাকার নবাবরা ‘বাইগন বাড়ি’ যেতেন, বন্য হাতি শিকারে বর্তমানে আমরা ওটাকে ‘বেগুন বাড়ি’ বলি। সেই সময় ঢাকার আশেপাশে অনেক বনভুমি, জঙ্গল ছিলো, সেখানে ছিলো হাতির অবাধ বসবাস। বন্য হাতি ধরে এনে রাখা হতো পিলখানায়, সেথায় বন্য হাতি পোষ মানানোর ব্যবস্থা ছিলো। সেই থেকেই এলাকার নাম পিলখানা। মোগল আমলে পিলখানার আরো ব্যাপকতা ছিলো, মাহুতরা বাস করতেন মাহুতটুলি। হাতিকে গোসল করানোর জন্য নবাবগঞ্জ এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে একটা ঘাট ছিলো তাই জায়গার নাম ‘হাতির ঘাট’।

ইংরেজ আমলে, পিলখানায় হাতিগুলোকে গোসল করানো হতো নদীর ঘাটে, খালে বা কোন ঝিলে। হাতিগুলো যে পথ দিয়ে প্রতিদিন আসা যাওয়া করতো, হাতির মল-মূত্রে রাস্তা ঘাট হতো অপরিচ্ছন্ন, পথিক ও নাগরিক দের সমুহ অসুবিধার কথা বিবেচনা করে, ইংরেজ কর্তৃপক্ষ হাতি গোসলের জন্য রমনা এলাকার খাল ও ঝিলগুলো নির্দিষ্ট করে দেন। ফলে গোসল করানোর জন্য প্রতিদিন বহু হাতি পিলখানা থেকে রমনা ও হাতির ঝিলে অাসতো, যে পথ দিয়ে হাতি চলাচল করতো, তাই সেই পথের নাম এ্যালিফ্যান্ট রোড। এই এ্যালিফ্যান্ট রোড আর পরিবাগের সংযোগস্থলে একটা পুল ছিল। এই পুলের দিয়ে হাতি আসা যাওয়া করতো, নামট তাই হাতিরপুল।

পুলটা তখনো ছিলো, তবে পরিত্যক্ত। পুলের আশেপাসে একটা গঞ্জ দোকান পাঠ, হোটেল রেস্টুরেন্ট, বাজার ছিলো, এ্যালিফেন্ট রোডের দু’পাশে, ছিলো দোকান পাঠ, বেশ মনে পড়ছে।

শাহবাগে থাকার কারনে সব কিছু এখনো দেখছি, বদলে যাওয়াও দেখেছি।

শাহবাগ থেকে নতুন একটা পথ তৈরি হলো সাইন্স ল্যাবরেটরি পর্যন্ত, নাম নিউ এ্যালিফেন্ট রোড, এইতো সেদিনের কথা।চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here