প্রত্যর্পণ চুক্তিতে কী আছে?

0
2

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্দি হস্তান্তরের আলোচিত ঘটনাটি ২০১৫ সালের। প্রায় ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে হস্তান্তর করা হয় অনুপ চেটিয়া ও নূর হোসেনকে। দুটি ঘটনাই ঘটে ঢাকা-নয়াদিল্লির মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরের আড়াই বছর পর। বন্দি বিনিময় সহজ করতে যে চুক্তিটি হয় ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি।

প্রায় এক যুগ পর প্রত্যর্পণ চুক্তি ও এর ফাঁকফোকর নতুন করে আলোচনায় আসে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিলে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সোমবার তাঁর মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

রায় ঘোষণার পর সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। বিষয় ছিল, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানকে ভারতে থেকে দেশে আনার প্রক্রিয়া। প্রশ্ন হলো- এই প্রত্যর্পণ চুক্তিতে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের বিনিময় নিয়ে কী উল্লেখ আছে। এর আওতায় শেখ হাসিনাকে ফেরত দিতে ভারত কতটা বাধ্য? নতুন করে বাংলাদেশ কোন প্রক্রিয়ায় চিঠি দেবে? ভারতের মনোভাব নিয়ে বিশ্লেষকরা কী অনুমান করছেন?

কী আছে চুক্তিতে
দুই দেশের মধ্যে হওয়া চুক্তির তথ্য আছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের ওয়েবসাইটে। চুক্তির একটি অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয় ২০১৬ সালের জুলাইয়ে।

২০১৩ সালের চুক্তিতে অনুচ্ছেদ আছে ১২টি। এর মধ্যে ১ ও ২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বিচারিক কর্তৃপক্ষের দ্বারা বিচারাধীন, অভিযুক্ত, দোষী সাব্যস্ত বা দণ্ড কার্যকরের জন্য যাদের খোঁজ চলছে, সেই ব্যক্তিদের রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে পাওয়া গেলে প্রত্যর্পণ করতে হবে। তবে অপরাধটি হতে হবে রাষ্ট্রের আইনে নূন্যতম ১ বছরের কারাদণ্ডযোগ্য।

চুক্তির প্রয়োগ কোন ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে তা উল্লেখ আছে অনুচ্ছেদ ৬-এ। বলা হয়েছে, যদি কোনো অপরাধের ধরন রাজনৈতিক বলে বিবেচিত হয় তাহলে প্রত্যর্পণের অনুরোধ গ্রহণ নাও হতে পারে। তবে হত্যা, হত্যার প্ররোচনা, অপহরণ, বেআইনিভাবে জিম্মি করাসহ ১৩ ধরনের অপরাধ রাজনৈতিক হিসেবে বিবেচিত হবে না।

প্রত্যর্পণ না করার ভিত্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে অনুচ্ছেদ ৮-এ। যাকে ফেরত চাওয়া হবে তিনি যদি অপরাধের মাত্রা, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সময় কিংবা অভিযোগটি ন্যায়বিচারের স্বার্থে আনা হয়নি- এসব বিষয়ে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেন তাহলে আশ্রয় দেওয়া রাষ্ট্র প্রত্যর্পণ করতে বাধ্য নয়।

কোন বিষয়ে সংশোধন আনা হয়
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ২৮ জুলাই দ্বিপাক্ষিক প্রত্যর্পণ চুক্তির অনুচ্ছেদ ১০ এর ৩ নম্বর ধারা সংশোধন করা হয়। পলাতক অপরাধীদের দ্রুত প্রত্যর্পণ নিশ্চিতের জন্য ওই সংশোধন আনা হয়। মূল চুক্তির এই ধারায় উল্লেখ ছিল, প্রত্যর্পণ চাওয়ার ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার সঙ্গে প্রয়োজনীয় প্রমাণ দিতে হবে। সংশোধনী অনুযায়ী, শুধু পরোয়ানা থাকলেই প্রত্যর্পণযোগ্য বিবেচিত হবে।

ভারত কি চুক্তি মানতে বাধ্য
গত বছরের অক্টোবরে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। সেখানে তিনি বলেছিলেন, এই চুক্তি যদি ভারত ঠিকমতো পালন করে তাহলে অবশ্যই তাদের শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়া উচিত। শুধু অভিযোগপত্র জমা বা শাস্তি পেলেই নয়, বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলেই এক দেশ আরেক দেশের কাছে কাউকে (আসামি) চাইতে পারে। রাজনৈতিক অপরাধের বিষয়টি ব্যতিক্রম হলেও একইসঙ্গে বলা আছে, হত্যাকে রাজনৈতিক অপরাধ ধরা হবে না।

এখন ভারত চুক্তিটির কেমন ব্যাখ্যা তৈরি করবে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। আইন উপদেষ্টা বলেন, চুক্তিটির নেতিবাচক ব্যাখ্যা দেওয়াও সম্ভব। ভারত বলতে পারে এটা ন্যায় বিচারের জন্য হয়নি। এখন এতো বড় গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার পরও যদি ভারত চুক্তির বিষয়টিকে এভাবে দেখে তাহলে অবশ্যই আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দিত হবে।

সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ কী করবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে উপদেষ্টা বলেছিলেন, অত্যন্ত কড়াভাবে প্রতিবাদ জানানো হবে। যেকোনো চুক্তিকে ভালো উদ্দেশে ব্যাখ্যা করাটাও আন্তর্জাতিক আইন। তারা যদি অন্য ব্যাখ্যা দেয় সেগুলোর বিপরীতেও আমাদের আইনি যুক্তি থাকবে। মোট কথা, ভারত যদি সততার সঙ্গে এই চুক্তিকে দেখে তাহলে তারা অবশ্যই শেখ হাসিনাকে ফেরত দিতে বাধ্য।

‘কীভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবে?’
শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়ে বিশ্লেষকদের কেউ বলছেন, ফেরত দেবে না। আবার কেউ বলছেন, না দিলে দিল্লি কূটনৈতিক টানাপোড়েনে পড়বে। ভারতের জিন্দল গ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ শ্রীরাধা দত্ত আল জাজিরাকে বলেছেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আদালতের সিদ্ধান্ত প্রত্যাশিত ছিল। তবে ভারত কখনোই তাঁকে প্রত্যর্পণ করবে না। কোনো অবস্থাতেই না।

ঢাকায় ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীও একই কথা বলছেন। তাঁর প্রশ্ন, ‘নয়াদিল্লি কীভাবে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে?’ আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের আগের শাসকদের এবং শেখ হাসিনার সঙ্গে বর্তমান প্রশাসনের সুসম্পর্কের প্রসঙ্গ উদাহরণ হিসেবে দেখান তিনি। বলেন, শেখ হাসিনা তাঁর মেয়াদে ভারতের প্রতি বন্ধুসুলভ মনোভাব দেখিয়েছেন। এখন ভারতের পক্ষ থেকেও নৈতিক অবস্থান নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান হলে কী হবে? বিবিসির গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক প্রতিবেদক অন্বরাসন এথিরাজনের মতে, ঢাকার কাছে বিরূপ কূটনৈতিক সংকেত যাবে। যা দুই দেশের সম্পর্ককে আরও চাপের মুখে ফেলবে। অনুরোধ মেনে নেওয়ার মানে হলো; দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্রকে উপেক্ষা করা। ফলে, ভারতকে এখন খুবই সংবেদনশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ পথে হাঁটতে হবে।

ঢাকার চিঠি, দিল্লির বিবৃতি
গত বছরের ৫ আগস্টের পর আদালত অবমাননার মামলায় শেখ হাসিনার সাজা হলে তাঁকে ফেরত চায় ঢাকা। কিন্তু নয়াদিল্লি সেটির আনুষ্ঠানিক জবাব দেয়নি। সোমবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, আদালত এখন যেহেতু শাস্তি দিয়েছেন, বিষয়টি ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।

চিঠি পাঠানোর প্রক্রিয়া নিয়ে উপদেষ্টা বলেন, একটি অফিসিয়াল নোটের মাধ্যমে যাবে। সেটা স্থানীয়ভাবেও তাদের (ভারত) মিশনকে হস্তান্তর করা যায়। অথবা আমাদের মিশন তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে হস্তান্তর করবে। বাংলাদেশ দুই প্রক্রিয়াই অনুসরণ করতে পারে।

উপদেষ্টার ব্রিফিংয়ের প্রায় কাছাকাছি সময়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শেখ হাসিনার রায় নিয়ে একটি বিবৃতি দেয়। এতে প্রত্যর্পণ নিয়ে স্পষ্ট কোনো ইঙ্গিত নেই। বলা হয়, ‘বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঘোষিত রায় নিয়ে ভারত অবগত। ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি ও স্থিতিশীলতাসহ সর্বোত্তম স্বার্থের প্রতি ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই উদ্দেশ্যে আমরা সব পক্ষের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে কাজ করে যাব।’

আলোচিত ‘বিনিময়’
ঢাকায় হওয়া ২০১৩ সালের প্রত্যর্পণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন দুই দেশের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দিন খান আলমগীর ও সুশীল কুমার সিন্ধ। এর আড়াই বছর পর গণমাধ্যমে অনুপ চেটিয়া ও নূর হোসেনকে হস্তান্তরের খবর আসে।

দেশি-বিদেশি কয়েকটি গণমাধ্যমের সে সময়কার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার শীর্ষ নেতা অনুপ চেটিয়াকে হস্তান্তর করা হয় ২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর (বুধবার)। ১৯৯৭ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি বাসা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। পরে অনুপ্রবেশ, জাল পাসপোর্ট ও অস্ত্র রাখার মামলায় ৭ বছরের সাজা হয়। এর মেয়াদ ২০০৭ সালে শেষ হয়। পরে তিনি ভারতে ফেরার আবেদন করেন। কিন্তু হস্তান্তরের আইনি জটিলতার কারণে তাঁকে হেফাজতে রাখা হয়।

আর নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের পর মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন কলকাতায় গ্রেপ্তার হন ২০১৪ সালের জুনে। অনুপ চেটিয়াকে হস্তান্তরের পরদিন তাঁকে ফেরত দেয় ভারত। এমন ঘটনাকে তখন ‘বিনিময়’ হিসেবে না দেখতে সাংবাদিকদের অনুরোধ করেছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। বর্তমানে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসাদুজ্জামানকে প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় ফেরত চাইছে অন্তর্বর্তী সরকার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here