হাফিজুর রহমান: এমন কোন বিখ্যাত মানুষ আমি নই যার স্মৃতিকথা না থাকলে পৃথিবী রসাতলে যাবে। তবু যে লিখছি, তার কারণ বোধকরি দ্রুত-চলমান সময়। বিংশ-শতাব্দীর মধ্যকাল থেকে এখন পর্যন্ত যে জটিল-ঋজু-কঠিন আবার উপভোগ্য অভিজ্ঞতা বুকে নিয়ে এগিয়েছি, তার কিছুটা পাঠকের কাছে তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই এই প্রয়াস।
৮.
সেন্ট যোসেফসে আমার প্রথম দিনগুলি কৌতুহলপূর্ণই ছিল। স্কুলের বিশালকায় অট্টালিকার চমত্কারিত্ব, স্যারদের নতুনতর ক্লাস-পরিচালন ও পাঠদান-পদ্ধতি, গ্রামের স্কুল থেকে উড়ে-আসা আমার মতো অর্বাচীন নবাগতের প্রতি নতুন বন্ধুদের বন্ধুত্বের প্রসারিত হাত–আমাকে দারুণ জমিয়ে রেখেছিল। স্কুলে যতোক্ষণ থাকতাম, তখন প্রায় ভুলেই যেতাম ফেলে-আসা দিনগুলির কথা। আমার মতো ভুঁইফোড় একটি বারো-বছরের বালকের পক্ষে সে যে কতোখানি অস্বাভাবিক কর্ম ছিল, এখন ভেবে অবাক হই।
আমার থাকার জন্যে স্কুলের পাশেই একটি ঘর ভাড়া করা হয়েছিল। আব্বার বন্ধু খুলনা নাট্যনিকেতনের তৎকালিন কর্মকর্তা জনাব আবুল হাশেমের পাঁচিল-ঘেরা বাড়ির সবুজ উঠোনের একপাশে দোচালা একটি গোলের ঘর। দুটো ঘরের একটিতে আমার কাকা আতিয়ার রহমান থাকতেন, অন্যটিতে আমি ও আমার সার্বক্ষণিক পাঠদানের জন্য রাখা গৃহ-শিক্ষক। তিনিই ছিলেন ভাড়া-বাসায় আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। কমার্স কলেজে পড়তেন। নিজের ছোট-ভাইয়ের মতো দেখভাল করতেন। অল্পদিনের মধ্যে তাঁর গ্রাজুয়েশন শেষ হলে তিনি অন্যত্র চলে যান। তিনি আমার মতো একাকী বালকটিকে কতোখানি মায়ায় বেঁধেছিলেন, তা বুঝলাম তাঁর চলে যাওয়ার দিনে। জীবনে প্রথম হয়তো কারো বিয়োগ-ব্যথায় অঝোর ধারায় কেঁদেছিলাম। পরে আরেকজন গৃহশিক্ষক এসেছিলেন, গোলাম রসুল। তিনি পড়াতেন চমৎকার, কিন্তু সেরকম মায়ার বাঁধনে বাঁধতে পারেননি।
কাকা ছোট-বেলা থেকেই আমাদের জন্য একজন ভীতিকর অস্তিত্বের নাম। তাই উপস্থিতির চাইতে অনুপস্থিতিই তখন সুখকর ছিল। কেবলই মায়ের স্নেহ-উৎপাটিত সেই কিশোর-আমি যে কেমন একাকীত্বের অসহায়তায় ডুবে গিয়েছিলাম, তা কেবল ভুক্ত-ভোগীর পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব ছিল। বুঝেছিলাম, একজন বালকের মানসিক গঠনের ঐকান্তিক প্রয়োজনেই সার্বক্ষণিক মাতৃস্নেহ অবশ্যম্ভাবী।
একাকীত্বের অসহনীয় দু:খবোধের সাথে সেই আমার প্রথম পরিচয়। সারাদিন স্কুলে সময় কাটিয়ে ঘরে ফিরলে একবুক কান্নার পাহাড় যেন ফুলে উঠে ঝড় বইয়ে দিতো বুকে।
তৎকালীন ডিস্ট্রিক্ট-বোর্ডের সদস্য হওয়ায় আব্বা খুলনায় এসে ডাকবাংলোতেই থাকতেন। মাঝেমধ্যে বিকেল হলেই একটুখানি প্রিয়-সান্নিধ্য-লাভের আশায় হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছাতাম সেখানে। কখনো পেতাম, কখনো শুনতাম, বাইরে গেছেন। তবু বুকের মধ্যেকার হাহাকারের যে আগুন থামাতে আব্বার মুখামুখি হতে ছুটতাম, কখনো আব্বাকে তা জানতে বা বুঝতে দিইনি। এভাবেই অসাধারণ একটা অপ্রকাশ্য নৈ:সঙ্গ-বোধ তখন থেকেই কেমন করে যেন আমার চির-জীবনের সাথী হয়ে ওঠে। আমি তাকে বুঝতাম, নেড়েচেড়ে দেখতাম, কষ্টটুকু আপনমনে সইতাম। বলা যায়, উপভোগও করতাম কিছুটা। সেই থেকে নৈ:সঙ্গ-বোধ সারাজীবনের সাথী আমার। তাকে সইতে কষ্ট পেলেও কখনো এড়াতে পারিনি। এখনো পারিনা। তাইই বোধহয়, অনেক মানুষের মধ্যে ঢুকেও সেই একা হয়ে যাওয়ার হাহাকার আমাকে আজীবন কুরেকুরে খায়। হয়তো এর মধ্যেই আমি আমার স্বাতন্ত্র্যটুকু স্পর্শ করে দেখার সুযোগ পাই।
একদিনের কথা মনে পড়ে। আব্বাকে না পেয়ে যারপরনাই হতাশ হয়ে বাড়ির জন্যে মন কেমন করে উঠলো। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে ফেইরিঘাট-মোড়ের বাস-স্ট্যান্ডে শুনলাম ডাকছে, কামারখালি। আসেন কামারখালি…!
ডুমুরিয়ায় আমাদের বাড়ির পিছনের বিলের নাম কামারখালি। কী মনে করে উঠে বসলাম। বাস যখন দৌলতপুর পেরিয়েছে, তখন কন্ডাক্টরের কথায় বুঝলাম বাসটি যেখানেই যাক, কামারখালির বিলে যাবেনা। হকচকিয়ে নেমে সদাশয় কন্ডাক্টরের পরামর্শমতো যখন খুলনায় ফিরেছি, তখন বেশ রাত। বাসায় ফিরে ভেবে নিলাম, আবেগের আতিশয্যে এমন হারিয় যাওয়ার ভুল আর কখনোই নয়।
আব্বার সাথে দেখা হলে প্রায়ই নিজাম হোটেলে ভরপেট খাওয়া হতো। হোটেলটিতে ঢুকলেই কী একটা ভিন্ন-স্বাদের মৌমৌ ঘ্রাণে বুক ভরে যেতো। সাফ-সুতরো পোষাকের অবাঙালি ওয়েটার কেমন একটা ভঙ্গিমায় যে উচ্চারণ করতো, দো প্লেট খানায়ইই…এখনো সেই শব্দোচ্চারণ ও স্বাদের ঘ্রাণ বুকের মধ্যে টের পাই।
বাড়িঅলা হাশেম সাহেবের ছেলে লালি স্কুলের প্রথম বন্ধু আমার। একবার কী কারণে যেন, আমাদের মধ্যে কথা বন্ধ ছিল কিছুদিন। একারণে ওর মধ্যে কোন কষ্টবোধ ছিল বলে মনে হয়নি। কিন্তু আমিই অভিমান ভেঙে ভাব করতে বাধ্য হয়েছিলাম। এছাড়াও পিটার রড্রিক্স,লাডলা, শহিদুল্লাহ, কামাল, আনিস, সাকি,আমিনুর,শাহু, সুজা, জয়দেব,মোশারফ,টিপু প্রমূখ ভালো বন্ধু ছিল আমার। অনেকের সাথেই এখনো যোগাযোগ রয়েছে। তবে পিটারকে যে সেই হারিয়েছি, আর খুঁজে পাইনি। ওর জন্যে সত্যিই খুব কষ্ট হয়।
আমাদের স্যারেরা আমার বুকে এখনো যেন নক্ষত্রের আলো জ্বালিয়ে চলেন। কল্যাণ কুমার রায়চৌধুরী যে বাংলা ব্যাকরণ বোধের আওতায় এনে দিয়েছিলেন, ইচ্ছে করেও তা আর ভুলতে পারিনি। নৃপেনবাবুস্যার, নিত্যলাল গোলদার, আজাহারস্যার, পরিতোষস্যার,অমিয় গাব্রিয়েলস্যার–এক একটা হীরক-খণ্ডের মতো বুকের ভিতরে যে আলোকমালার ফুলকি ছড়িয়েছেন, তা শুধু অতুলনীয়ই নয়, অননুকরণীয়ও বটে। জীবনের বোধ ও বোধীর গড়ন-পেঠনে এঁদের পরিচর্যা সেই সময়ে বড্ড প্রয়োজনীয় ছিল।
ক্লাস এইটে থাকতেই একদিন হঠাৎ ক্লাস-টিচার আমার নাম ধরে ডেকে বললেন, তুমি বাসায় চলে যাও এক্ষুনি। কারণ বলেননি। বুঝতেও পারিনি কিছু। দৌড়ে ছুটে গিয়ে দেখি আমাদের ভাড়া-ঘরে আগুন জ্বলছে। কিছুই বের করতে পারা যায়নি। আগুনে সব পুড়লেও বুকের কষ্ট পোড়েনি মোটেই। সামনের বাড়ির আফসার চাচা আব্বার প্রিয়জন, বড়চাচার সহপাঠী বন্ধু ছিলেন। সেদিন তাঁদের বাড়িতে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা হয়েছিল। চাচার মেয়ে সায়রা’বু খুব আদর করতেন।
আমাদের সেই আগুনেপোড়া বাসার পাট চুকিয়ে কিছুদিন সুশীল সরকারের লেনের এক ঘরে থেকে, পরে জোড়াকল-বাজারের কাছে ট্যান্ডল-গনির বাড়িতে যেয়ে উঠেছিলাম। এই বাসায় থেকেই আমার এসএসসি এবং এইচএসসি-পরীক্ষা দেওয়া। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরও আব্বা এই বাসাতেই থাকতেন। এই বাসাটির দিনগুলি আমার ভিন্নতর অভিজ্ঞতার সূতিকাগার হয়ে রয়েছে। (চলবে…)