শওকত আহসান ফারক: আমি রসায়ন বিষয় নিয়ে পড়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বেড়ে উঠা কুমিল্লা শহরে, শৈশব কেটেছে জন্মভুমি হাটখোলা কুমিল্লা গ্রামের বাড়িতে। পিতা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের রসায়নের শিক্ষক সেই সুবাদে, কুমিল্লায় স্কুল জীবন শুরু। শহর ও গ্রামের রসায়ন নিয়ে গড়েছি নিজের জীবন।
কুমিল্লা জিলা স্কুল ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়া কালীন সময়ে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম। সাহিত্য ভালোবাসি, গল্প কবিতা লিখি, ভালোলাগে তাই।
১৯৭০ সালে ‘আমরা জ্যোৎস্নার প্রতিবেশী’ শিল্প ও সাহিত্য সংস্থার একজন নির্মাতা, সফল সংগঠক।
বহুজাতিক ঔষধ কোম্পানিতে বিপনণ পেশায়, কর্মজীবন শুরু ১৯৮০ সালে। সেই সুবাদে দেখেছি বাংলাদেশ, দেখেছি প্রান্তিক মানুষের যাপিত জীবন।
আড্ডা,গান শুনতে ভালোবাসি। প্রিয় শিল্পী শচীন দেব বর্মণ, প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ। ব্যক্তিগত জীবনে দুই ছেলে এক মেয়ের জনক। এখন আবসর জীবন যাপন করছি। পঁয়ষট্টি বাৎসরের জীবনে ফিরে দেখা অতীত ও ঐতিহ্য নিয়ে লিখেছি, ‘যে স্মৃতি ধূসর হয়নি’, যে স্মৃতি।’ বর্তমানে লিখছি, রুম নাম্বার ১৪৬। সেটিকেই এখানে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।
(১)
১৯৭৪ সালে প্রথম হলে উঠি, সাবসিডিয়ারি পরীক্ষার আগে, রুম নাম্বার ওয়ান ফর্টি সিক্স। আজ গিয়েছিলাম কার্জন হলে রসায়ন বিভাগের মিলন মেলায়।
কাঠগোলাপ আমার সব সময় প্রিয়, একটু ভারী পাপড়িযুক্ত কেমন গাছে তেমন পাতা নেই শতফুল ফুটে আছে, গাছটা তেমনই আছে, এখানে কেটেছে আমার যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়।
যতবার ফজলুল হক হলের পূর্ব পাশে দিয়ে গিয়েছি, ওয়ান ফোর্টি সিক্স রুমটা তাকিয়ে দেখেছি, এখানেই ছিলাম, আশি সাল অবধি, বন্ধু ইসমাইলকে বললাম চল ওয়ান ফর্টি সিক্স, স্মৃতিময় পথ ধরে ঘুরে এলাম, এখন সেখানে থাকে নতুন দু’জন, কথা বললাম ছবি তুললাম, আমি ও ইসমাইল প্রথম রুমমেট ছিলাম, এখন ওরা থাকে।
মনে হলো রুমটা আগে অনেক বড় ছিল, আজ খুব ছোট লাগছে, অনায়াসে এই রুমে ১৫/২০ জন নিয়মিত আড্ডা দিয়েছি। আমার খুব কম বন্ধুই আছে যে ওয়ান ফর্টি সিক্সে যায়নি।
যারা যায়নি, — চলো একটু ঘুরে আসি।
ভার্সিটি এলাকায় ওয়ান ফর্টি সিক্স বললে, বলতে হতো না এটা কোথায়, কোন হলে? এতটা দাপুটে ছিল, সেই রুম নাম্বার ১৪৬।
(২)
দেখা হলো প্রিয় শিক্ষক ড. মসিউজ্জমান স্যারের সাথে, ২য় বর্ষে পড়াতেন জৈব রসায়ন, কোন ক্লাশ মিস করিনি, প্রথম ক্লাশেই ভাল লেগে গেলো।
সুন্দর সুশ্রী গড়ন, কমনওয়েলথ বৃত্তিতে পিএইচডি করে দু’বছর হলো, রসায়ন বিভাগে যোগ দিয়েছেন, সহকারী অধ্যাপক হিসাবে। ১৯৬২ সালে এখানে ভর্তি হয়েছেন, ঢাকায় এসেছিলেন প্রকৌশলী হতে, কার্জন হল দেখতে এসে, রসায়নে ভর্তি হয়ে এখনেই রয়ে গেলেন, জায়গাটা ভালোলেগে গেল তাই।
সেই থেকে এখানেই, বিলাত থেকে আনা ছাতি স্যার, সারা বছরই ব্যবহার করতেন।
এখন চলছে প্রায় পঁচাত্তর তেমনই সুন্দর আছেন, সোনালী আঁশ পাটের উপর আনেক কাজ করেছেন। দেশকে ভীষণ ভালবাসেন, বাঙলা ভাষা কে আরো বেশী ভালোবাসেন।
রসায়নের শিক্ষক বাঙলায় দখল ঈর্ষান্বিত করেছিল আমাকে সেই সময়, সাহস করে কোনদিন বলিনি এতোই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ছিলেন, আজ মিলনমেলায় তিনিও এসেছেন প্র্যাক্তন ছাত্র হয়ে আমার মতো।
বলে ফেল্লাম ৪৪ বৎসর পর, সেই ‘৭৩ সালে ক্লাশের কথা।
— স্যার, আপনি একটাও ইংরাজি শব্দ ব্যবহার না করে, জৈব রসায়ন এর মত একটা বিষয় কিভাবে পড়াতেন?
তাকিয়ে রইলেন অপলক আমার দিকে, একটা ছোট্ট জবাবে সব বলেদিলেন।
— শওকত, সদিচ্ছা থাকলে সবই সম্ভব।
(৩)
মনে পড়ে গেল ভীষণ ভাবে সেই নোলক পড়া মেয়েটার কথা, পুরানো জায়গা একটু ঘুরে ঘুরে দেখছি, সেই সময় থেকে ভার্সিটি এলাকা ছাড়িনি। ছেলে মেয়ে সব্বাই উদয়ন বিদ্যালয়ে পড়েছে, নিয়মিত আসাযাওয়া আমার এই ক্যাম্পাসে। ছায়ানট, কলা ভবন, টিএসসি, কার্জন হল, বাঙলা একাডেমী সব স্মৃতিময় জায়গা।
কোন কিছুই আর আগের মত নেই, ক’দিনে বদলে গেছে, কলাভবন আর আগের মতো নেই খোলামেলা, দালান কোঠায় ঠেসে গেছে তবুও সবুজ। এতো সবুজ আর কোথাও নেই। শহরের সব সবুজ হারিয়ে ফেলেছি। ক্যামপাসটা সর্বদা নিজের মনে হয়, একান্ত আপন। কলাভবন লাইব্রেরীর বারান্দায় বসে আড্ডা, প্রিয়জন বা বন্ধু সাথে হয়তো ৫০ পয়সার বাদাম, ঝালমুড়ি সাথে কবিতা গল্প, বেশ ছিলো দিনগুলো।
এখনো তেমনই চলছে আড্ডা, তবে বাদামের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে পাকোড়া, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চিকেন, চটপটি, ফোসকা, আইসক্রিম। আড্ডাটা ঠিকই আছে, সেই আগের মতো, আমি বারান্দায় বসে কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে গেলাম, সেই দিনগুলোতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার’ এর সামনে একটা সেলফি তুলতেই হয়। এগিয়ে এলো দুজন যুবক, হয়তো আমাকে ভালো লেগেছে, এগিয়ে এলো আলাপ করলো।
— কিসে পড়ো?
— এম.বি.এ, ফাইনাল দেবো।
— আমিও এখানে পড়েছি ‘৭৩ থেকে ‘৭৮ সাল অবধি।
মনে পড়ে গেলো, আমার প্রথম ভার্সটিতে ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম নেবার ঘটনা। একটা বিষয়ই পড়বো রসায়ন, যদিও প্রি-ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয় নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছি, বুয়েট থেকে ভর্তির ফর্ম নিয়ে, জমা দেওয়া হয়নি।
ভর্তির ফর্ম দিচ্ছে রসায়ন বিভাগে আমিও গেলাম কার্জন হলে, লাইনে দাঁড়িয়ে ফর্ম নিতে, মনে ধরার মতো একটা মেয়ে ফর্মের জন্য দাঁড়ালো, আমি ঠিক পেছনেই দাঁড়ালাম, নাকে নোলক পড়া’, দেখেই মনে হয় এফুলেন্ট, নামটা জেনে নিতে ভুল করিনি, হাসলে গালে টোল পড়ে, সপ্রতিভ, নাম মধুছন্দা, অতি সাধারণ আলাপ।
— কোন কলেজে পড়েছো।
— হলিক্রস, আপনি?
— কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া, মফস্বলের ছেলে।
— দেখে তো মনে হয়না, আপনি যে ভাবে কথা বলছেন, ঢাকার ছেলেরাও মেয়েদের সাথে এভাবে ফ্রিলি কথা বলতে পরে না, শাই ফিল করে।
— তাই নাকি?
— হুম ভীষণ শাই, চোখের দিকে তাকিয়ে, ক’জন কথা বলতে পারে অপনার মত।
ধন্যবাদ দিয়ে কথা শেষ হলো, সেদিনের আলাপ এতটুকুই।
মধুছন্দা, ছদ্মনামই ব্যবহার করলাম, রসায়নে ভর্তি হয়নি, ফার্মেসীতে পড়ছে।
আমাদের সময়, সেইসব সুন্দর মুখগুলো ভর্তি হয়ে, সহসা করো না কারো সাথে জড়িয়ে পরে, একটু মস্তান টাইপের ছেলেই বেশী পছন্দ।
একদিন হয়তো লনে বসলো দু’জনে, দু’দিন সাইকেল পার্কিংএ, টিএসসি ক্যাফে’তে দুপুরের খাওয়া ব্যাস হয়ে গেলো, সুন্দরীর ভার্সিটি লাইফ কনর্ফাম ও নিরাপদ। কেউ আর বিব্রত করবেনা, এটাই সাধারণ সৌজন্যবোধ, আমাদের শিষ্টাচার। মধুছন্দা হয়তো এই কাজটা করার সুযোগ পায়নি, নিজেই পেয়ে গেলো, ডিপার্টমেন্টের বড় ভাইয়ের টেন্ডার, মস্তান টাইপের নয়, মস্তানই, ছাই দিয়ে ধরেছে, অগত্যা।
আমাদের সময় অনার্স পরীক্ষা হতো, কার্জন হলে ৪ ঘন্টার পরীক্ষা, এক টেবিেলে একজন। ভর্তি পরীক্ষা মধুছন্দার সাথে দিতে পারিনি, অনার্স পরীক্ষায় সিট পড়লো, দৈবক্রমে পাশাপাশি টেবিলে, তারপর!
ঘটে গেলো, জীবনের এক অদ্ভুত সুন্দর রসায়ন, হলে গিয়েছি, পাশাপাশি বসে ছিলাম মধুছন্দার সাথে, ৫ দিনে ৭২০০০ সেকেন্ড।