দ্বীন কায়েমের জন্য আওয়াম এবং উলামায়ে কেরামের মাঝে সুসম্পর্ক অটুট থাকা অপরিহার্য। মতভিন্নতা সত্ত্বেও রক্ষা করতে হবে সম্প্রীতি। তুলতে হবে ঐক্যের সূর। আল্লাহতায়ালার অশেষ মেহেরবানি ও রহমতের নিয়ামক-দাওয়াত ও তাবলিগের মহান দায়িত্ব আদায়কারী জামাতের পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি নিরসনে সবাইকে মুখলিসানা ভূমিকা নিতে হবে।
তাবলিগ জামাতের চলমান সংকটের বিষয়ে দ্বীনদরদিরা উদ্বিগ্ন। তাবলিগকে গতিশীল রাখার জন্য সবার আন্তরিকতা ও ঐকান্তিক চেষ্টা প্রয়োজন।
পূর্বসূরিদের চেতনাসিক্ত তাবলিগের এই মহান কাজের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ ও উলামায়ে কেরামের মধ্যে যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তা যেন কোনো কারণেই ভেঙে না পড়ে।
দূরে ঠেলে নয়, আপন করে নিতে হবে সবাইকে। আওয়াম তথা সব শ্রেণী-পেশার মানুষের আ’ম হেদায়াত এবং দ্বীন শেখার একমাত্র মার্কাজ তাবলিগ জামাতের বিবদমান দুই পক্ষের দিমুখী দৃঢ় অবস্থানের কারণে সমাজে এ জামাত নিয়েই নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন মসজিদ ও এলাকায় বন্ধ করা হচ্ছে উভয়পক্ষের কার্যক্রম।
কাকরাইল মসজিদে দফায় দফায় যেভাবে সংঘর্ষ হচ্ছে, এতে পুরো জামাতেরই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। একসঙ্গে চলা সম্ভব না হলে দুই পক্ষের কার্যক্রম জুদা করে দেয়া হোক।
দুই পক্ষ স্বাধীনভাবে মেহনত করতে থাকুক। কারণ বিবাদে জড়ানোর চেয়ে জুদা থাকাই ভালো। তাবলিগ জামাত এক প্রচণ্ড ঝড় মোকাবিলা করছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় শতবর্ষস্পর্শী এ জামাতটি এখন নিদারুণ কিছু বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। সংকটের এ সময়টিকে আমরা ইসলামের সূচনালগ্নের সঙ্গেও মিলিয়ে দেখতে পারি।
হজরত উসমান (রা.)-এর সময় সংগঠিত ফিতনা, সিফফিন ও উষ্ট্রীর যুদ্ধসহ অপ্রিয় অনেক ইতিহাসই রয়েছে। এ সমস্যাগুলো হয়েছিল নিজেদের মধ্যেই। মুসলমানের হাতেই রঞ্জিত হয়েছিল আরেক মুসলিম ভাই।
সময়ের ব্যবধানে ভাইয়ের তরবারি উঠেছিল ভাইয়ের বিরুদ্ধে। অপ্রিয় এ বাস্তবতাকে ধারণ করেই পৃথিবীতে এখনও টিকে আছে ইসলাম। কিন্তু ভ্রাতৃঘাতী এ দুর্যোগে আমাদের করণীয় কী? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংশ্রবধন্য সাহাবাদের আমল আমাদের কী শেখায়?
প্রথমেই বুঝতে হবে, এটি কোনো হক-বাতিলের লড়াই নয়। এটি পরস্পরের মতপার্থক্য। মুসলমানদের পরস্পর মতপার্থক্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মতপার্থক্যের সীমারেখাও বাতলিয়ে গেছেন। আমি যে চিন্তা করছি, তা তো ওহি নয়। আমার বিপরীত মতটিও সত্য হতে পারে।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে আমার মতটি উত্তম। আল্লাহর ফায়সালা হলে আমার মতটি প্রতিষ্ঠিতও হতে পারে। আল্লাহ না চাইলে নয়। কিন্তু আমি তো আমার অন্য ভাইকে মতপার্থক্যের কারণে বাতিল বলতে পারি না।
এ অধিকার আল্লাহ আমাকে দেননি। প্রমাণ ছাড়া কোনো মুসলমানকে যদি আমি বাতিলের গুপ্তচর বলি, তাহলে এর জবাব কি আল্লাহর কাছে আমাকে দিতে হবে না? হজরতজি ইলিয়াস (রহ.)-এর বংশধর যদি বাতিলের ক্রীড়নকে পরিণত হয়, তাহলে তো এ লজ্জা আমাদের। এর ব্যর্থতা সব আলেমদের।
কিন্তু হায়, প্রতিপক্ষকে ঘায়েলে আমার যত তৎপরতা, এর সামান্যটুকুও দ্বীনের প্রসারে করি না। নিজ ভাইয়ের বিরুদ্ধে লড়াকে আমি জিহাদ মনে করছি। হে ভাই, তোমাদের জিহাদি চেতনাকে আমার লাখো সালাম।
হায়, এমন অবিবেচক কথাগুলো বলা ও শোনার যুগও আমাদের দেখতে হচ্ছে। তাবলিগের কোনো এক পক্ষ হয়ে জেতার যে প্রবল জিদ ভর করেছে আমাদের ওপর, এর জন্য অনলাইন-অফলাইনে যে মেহনত আমি করছি, তার সিকিভাগও কি দ্বীনের জন্য করেছি? এ সময়টুকু যদি উম্মতের মাঝে ব্যয় করি, তাহলে এ দেশে দ্বীন সম্পর্কে কোনো অজ্ঞ লোক থাকবে না।
আমাদের দ্বীনি কর্মকাণ্ড যেন এগিয়ে চলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবাদের বাতানো পথে। বিবেকের কালো মেঘ দূর হয়ে যাক, ঈমানের শুভ্রতায় আলোকিত হয়ে উঠুক প্রতিটি হৃদয়।
দ্বীন হেফাজতে তোমার কর্মতৎপরতায় আমি অভিভূত। কিন্তু আমাদের স্বর্ণালী যুগের পূর্বসূরিরা আমাদের কর্মে যেন লজ্জায় মুখ না লুকায়। আমাদের ভুলে যেন পথ হারিয়ে না ফেলে সাধারণ মানুষ।
তাই জজবার সঙ্গে সবসময় যেন সাথী হয় বিচক্ষণতা। তোমার এই জিহাদী জজবার ঘোড়াটিকে একটু শরিয়তের লাগাম পরিয়ে দাও। ভালো করে ভেবে দেখ, তোমার দৃষ্টিতে যা জিহাদ, আল্লাহর কাছে তা যেন জুলুম না হয়ে যায়।








