শওকত আহসান ফারুক: আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন নিয়ে পড়েছি। বেড়ে উঠা কুমিল্লা শহরে, শৈশব কেটেছে জন্মভুমি হাটখোলা কুমিল্লা গ্রামের বাড়িতে। শহর ও গ্রামের রসায়ন নিয়ে গড়েছি নিজের জীবন।
এখন আবসর জীবন যাপন করছি। পঁয়ষট্টি বৎসরের জীবনে ফিরে দেখা অতীত ও ঐতিহ্য নিয়ে লিখছি, রুম নাম্বার ১৪৬। সেটিকেই এখানে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।
৭৩.
একাত্তরে জুন/জুলাই মাসে ত্রিপুরা থেকে সৈয়দ রেজাউর রহমানের প্রকাশনা ‘সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়, মুক্ত বাঙলায় এটাই প্রথম সাপ্তাহিক। স্বাধীনতার পরেও ঢাকা থেকে নিয়মিত পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছে, ফারুক ভাই নিজে বলেছেন।
‘সাপ্তাহিক বাংলাদেশ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা আগরতলা থেকে ছাপা হতো, উদ্যোক্তা সৈয়দ রেজাউর রহমান, সহযোগিতায় ছিলেন অধ্যাপক খোরশেদ আলম, এম.এন.এ, এবং সম্পাদক আবদুল মান্নান চৌধুরী, আমি তখন মুজিব বাহিনী গেরিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দেরাদুনে। যুদ্ধ শেষে আমি পত্রিকাটি সম্পাদনার দায়িত্ব নেই, মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত একমাত্র পত্রিকা ছিল সাপ্তাহিক বাংলাদেশ।’
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ফারুক ভাই শেখ ফজলুল হক মনির সাথে আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এবং প্রথম কমিটিতে সৈয়দ রেজাউর রহমান, প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং ফারুক ভাই সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ঢাকা দিলকুশা আদমজী কোর্ট থেকে, নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, ১৯৭৪ সালে যখন সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয় সেইসময় পর্যন্ত সুন্দর লাইনো টাইপে, ঝকঝকে ছাপায় একটি কাগজ প্রকাশিত হয়েছে।
আদমজী কোর্টে ছিলো আরো একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘লোলিটা’। মনিরুল হল চৌধুরী, সৈয়দ রেজউর রহমান ও সৈয়দ আহমাদ ফারুক সবাই এর সাথে যুক্ত ছিলেন। আমরা তখন ঢাকায় সেই পত্রিকা অফিসে নিয়মিত আড্ডা দিয়েছি। তারেক পত্রিকার সাহিত্যের পাতা দেখাশোনা করতো।
ফারুক ভাই ছাত্র রাজনীতির সাথে স্কুল থেকেই জড়িত, সহপাঠী ছিলেন মাইনুল হুদা, শিব নারায়ন দাস মতো তুখোড় ত্যাগী কর্মী। আমি ১৯৬২ সালে কুমিল্লা জিলা স্কুলে ক্লাশ ফাইভে যখন ভর্তি হই ফারুক ভাই তখন দশম শ্রেণীতে পড়েন। তখনই দেখেছি হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট নিয়ে শিব নারায়ণ রায়ের নেতৃত্বে আন্দোলন করতে। শিবুদা হিন্দু বিধায় ভারতীয় চর আখ্যা দিয়ে সরকারী কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে বহিস্কার করে দেওয়া হয়।
১৯৬৩ সালে মাধ্যমিক, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে সম্মানে ভর্তি হন। ছাত্রলীগ থেকে, ১৯৬৯-৭০ এবং ১৯৭০-৭১ দুই দুই বার স্যার সলিমুল্লা মুসলিম হল ছাত্র সংসদের সহ সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। সলিমুল্লাহ্ হলের দোতালার পশ্চিম দক্ষিণ কোণার রুমে থাকতেন।
ছাত্রলীগের কোন কাজে ঢাকায় এলে সেই রুমে ফারুক ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছি, ফারুক ভাইয়ের খরচের হাত ছিলো অবারিত, সেই সময় দেখা হল, পকেটে হাত দিয়ে একটা নোট গুঁজে দিয়ে বলতো,
— সিনেমা দেখিস। কুমিল্লা ঝাউতলা আমাদের বাড়ি, আমরা প্রতিবেশী। নামের মিল থাকাতে ফারুক ভাই বলতো তুই ও SAF, শওকত আহসান ফারুক, আমিও SAF, সৈয়দ আহমাদ ফারুক। চলা ফেরায় ভীষণ ঝকঝকে নিপাট ভদ্রলোক। আমাদের মাঝে যোগাযোগ, সম্পর্ক, সম্মান ও স্নেহ এখনে রয়েছে সেই থেকে অটুট।
ফেসবুক এখন সবার সাথে যোগাযোগ আরো সহজ করে দিয়েছে মুহুর্তে হয়ে যায়, সবার সাথে সবার যোগযোগ, হয় ভাবের লেনদেন।
এবার ফারুক ভাই পবিত্র হজে পালন করতে গিয়েছেন, এতো ব্যস্তার মাঝেও প্রায় প্রতিদিন আমার সাথে যোগাযোগ রেখেছেন। একটি বার হলেও জানতে চেয়েছেন,
‘– ভাইয়া তোর লেখালেখি চালিয়ে রাখিস, আমি সেই সুদূরে বসে তোর লেখা নিয়মিত পড়ছি, মনে হয় তোদের সাথেই আছি।’
৭৪.
জহিরুল হক দুলাল, অগ্রজ কবি বন্ধু। দুলাল ভাইয়ের উদ্যোগে ‘আমরা জ্যোৎস্নার প্রতিবেশী’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের জুন মাসে। আমি তখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের সংসদের সাহিত্য সম্পাদক। লেখালেখি আর ‘পেড়া ভান্ডরে’ আড্ডা। আমার বাড়িতে ‘পলাশ’ ১৯, ঝাউতলা সংঘটিত করি, ‘আমরা জ্যোস্নার প্রতিবেশী’ সাহিত্য সংঘটন।
কবিতা পড়ুন
কবিতা লিখুন
কবিতা নিঃসঙ্গ মুহুর্তে, আপনার অন্তরঙ্গ হয়ে উঠবে।
এই ছিলো আমাদের শ্লোগান।
১৯৬৯ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি আনসার আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হক দুলাল। আমাকে ছাত্রলীগে জয়েন করার ব্যাপারে দু’জনে সচেষ্ট ভূমিকা রেখেছিলেন। বাসায় এসে উদ্বোধ্য করেছেন, শেখ মুজিবের কথা বলেছেন, স্বায়ত্তশাসন এর কথা, ছয় দফার কথা।
সেদিন সন্ধ্যায় কুমিল্লা ক্লাবের বারান্দায় দুলাল ভাইয়ের সাথে দেখা, আমি কুমিল্লা গিয়েই কল দিলাম দুলাল ভাইকে, চলে আসুন গল্প হবে।
– শওকত, আমি আসছি, তুমি থেকো।
আমরা আমার বাড়িতে কত রাত কাটিয়েছি, ১৯৬৯-৭৩, আমাদের আলাপে থাকতো নিরাপদ বিষয় বস্ত গল্প-কবিতা। বাইরে বৃষ্টি ছিলো, ক্লাবের গরম আলুর চপ ও চায়ের সাথে আড্ডা জমেউঠলো। আলাপ হলো, আমাদের পত্রিকার কথা।
প্রতিনিধি থেকে ইস্তেহার
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা। আনসার আহমেদ ও দুলাল ভাই দু’জনে ভালো বন্ধু, তুই সম্বোধনে কথা বলেন। মার্চে কারফিউ শিথিত হলে দুজনে চলে যান ‘সোনামুড়া’। একসময় চলে দুজনে চলে যান কলকাতা, সেখানে ‘কল্যাণী’ তে মেজর মঞ্জুর ৮/৯ নাম্বার সেক্টরে সক্রিয় ছিলেন। সেখানে খবর পান দু’জনকেই আগরতলা চলে আসতে, এখনে নেতৃস্থানীয় প্রয়োজনীয় লোকের অনেক অভাব।
কলকাতা থেকে ত্রিপুরা এসে মেলাঘরে, ২ নম্বার সেক্টরে যোগদেন। সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশারফ, দুলাল ভাইয়ের সাথে আলাপ করে, দাপ্তরিক কাজে নিয়োগ দেন, মেলাঘর ক্যাম্পে। সেখানে দুলাল ভাই প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য দুটি কাজ করতেন। প্রকাশ্য ছিলো ট্রেনিং নিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধা দের একটা দিক নির্দেশনা দেয়া, মানে মটিভেশন, দেশপ্রেমে উদ্বোধিত করে যুদ্ধে প্রেরণ করা।
অপ্রকাশ্য কাজটা ছিলো, প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গা থেকে আনেক গোয়েন্দা তথ্যাদি আসতো, দুলাল ভাই এগুলো ফাইলআপ করে, প্রয়োজনীয় বিষয় গুলো নিয়ে খালেদ মোশারফ এর সাথে বসে ব্যবস্থা নিতেন। একজন সক্রিয় সহযোগী।
জুলাই/অাগস্টের দিকে, মেলাঘরে তেমন কাজের চাপ নেই, শিল্প সাহিত্য যার রক্তে কি করবেন, আনসার ভাইয়ের সাথে আলাপ করে ‘সাপ্তাহিক প্রতিনিধি’ নামে একটা চার পাতার ট্যাবলয়েড সাইজ পত্রিকা বের করেন। প্রকাশক আনসার আহমেদ, জহিরুল হক দুলাল সম্পাদক।
প্রতিনিধি পত্রিকা ছাপা হওয়ার পর প্রবাসী সরকার সব কপি গুলো কিনে নিয়ে দেশের ইয়ুথ ক্যাম্পে বিলি করতো। আগরতলায় ছাপাখানা তেমন উন্নত ছিলো না, অনেক কষ্ট করে মুক্তিযোদ্ধা দের অনুপ্রাণিত করে, বিভিন্ন লেখা ছাপা হতো।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে, ভগবতি পেড়া ভান্ডারে বসে একদিন আনসার ভাই বললেন শওকত, সাপ্তাহিক প্রতিনিধি আবার প্রকাশ করবো, তুমি হবে এর সম্পাদক। আমরা ডিসি অফিসে নামের জন্য আবেদন করি, প্রতিনিধি নামে ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয় বিধায় অন্য নামে করতে হবে। দুলাল ভাই তাৎক্ষণিক নাম পাল্টিয়ে দিলেন, ‘পাক্ষিক ইস্তেহার’।
আনসার আহমেদ, প্রকাশক, জহিরুল হক দুলাল, সম্পাদক, শওকত আহসান ফারুক, কার্যকরী সম্পাদক। নিউ মার্কেটের কর্ণফুলী প্রেস থেকে, ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, পাক্ষিক ইস্তেহার প্রথম কপি প্রকাশিত হয়। চার পৃষ্ঠার একটি পত্রিকা। ১৯৭৩ সালে জুন/জুলাই মাসে আমি ঢাকা চলে আসার আগ পূর্যন্ত পাক্ষিক ইস্তেহার প্রকাশ করেছি।
৭৫.
পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি, পিস কমিটি। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক গঠিত সহায়তা প্রদাকারী বাহিনী। জামায়েতে ইসলাম প্রধান গোলাম আজমের নেতৃত্বে। প্রধান উদ্দেশ্য ছিল-বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীকে দমন করা।
২৫শে মার্চ রাতেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ৪ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে, নুরুল আমিন, গোলাম আযম ও খাজা খায়রুদ্দিনসহ ১২ জন পাকিস্তানপন্থী নেতা, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল টিক্কা খানের সাথে দেখা করেন এবং স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে সহযোগিতার নিশ্চিতয়তা প্রদান করেন। আলোচনার পরে, ডানপন্থী নেতারা, পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি পুনরুদ্ধারে ১৪০ জন সদস্যবিশিষ্ট শান্তি কমিটি গঠন করে। খাজা খায়রুদ্দিন ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল ঢাকায় বৈঠকে শান্তি কমিটিতে রাজাকার নিয়োগ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলছে দেশে বিরাজমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তান প্রশাসনকে সহযোগিতা করার লক্ষে ও জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ১০ এপ্রিল ঢাকায় শান্তি কমিটি গঠিত হয়।
কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান হন মুসলিম লীগ নেতা খাজা খয়েরউদ্দীন। নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দলের কারণে ফরিদ আহমদের নেতৃত্বে একটি অংশ মূল কমিটি থেকে বেরিয়ে এসে ‘স্টিয়ারিং কমিটি’ গঠন করে। এই স্টিয়ারিং কমিটি পরে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটির রূপ নেয় এবং এর নামকরণ হয় পূর্ব পাকিস্তান শান্তি ও কল্যাণ কাউন্সিল।
শান্তি কমিটি গঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করা এবং দেশকে বিচ্ছিন্নতা থেকে রক্ষা করে পাকিস্তান কে টিকিয়ে রাখা। ক্রমান্বয়ে সারা দেশে শান্তি কমিটি গঠিত হয়।
স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা এসব কমিটি গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্নভাবে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেন। মুক্তিযোদ্ধা দের গতিবিধি লক্ষ্য রেখে সেনা বাহিনীকে খবরা খবর পৌঁছে দিতেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি ঘরের ঠিকানা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও মেয়েদের ধরে এনে সামরিক জন্তার কাছে ভোগের নিমিত্তে সহায়তা প্রদান করেছে নিয়মিত।
তবে কিছু কিছু ব্যাতিক্রম ছিলো। অনেকেই বাধ্য হয়ে, রাজারার, আল বদর, আল সামস হয়েছে। এদের অনেকেই এই সব বাহিনীতে থেকেও মুক্তিযোদ্ধা দের সহায়তা করেছে গোপনে।চলবে……………..।