রুম নাম্বার ১৪৬ (৫২)

0
272
Showkat Ahsan Farugue-Deshinfo
Showkat Ahsan Farugue-Deshinfo

শওকত আহসান ফারুক: আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন নিয়ে পড়েছি। বেড়ে উঠা কুমিল্লা শহরে, শৈশব কেটেছে জন্মভুমি হাটখোলা কুমিল্লা গ্রামের বাড়িতে। শহর ও গ্রামের রসায়ন নিয়ে গড়েছি নিজের জীবন।

এখন আবসর জীবন যাপন করছি। পঁয়ষট্টি বৎসরের জীবনে ফিরে দেখা অতীত ও ঐতিহ্য নিয়ে লিখছি, রুম নাম্বার ১৪৬। সেটিকেই এখানে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা।

১৫১.

একাত্তরে ১৭ ডিসেম্বর জহির রায়হান কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন। ফিরে এসেই শুনলেন তার অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সার ১৪ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ। আদর্শস্থানীয় বড় ভাইকে হারিয়ে তিনি পাগলের মত তাকে খুঁজতে থাকেন। নিজ উদ্যোগ জহির রায়হান বেসরকারি বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডসহ অন্যান্য ঘটনার প্রচুর প্রমাণাদি তিনি সংগ্রহ করেছিলেন, ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্তের অগ্রগতি হয়েছে এই কথা বলেছিলেন।

৩০ জানুয়ারি রোববার সকালে এক রফিক নামের অজ্ঞাত টেলিফোন আসে জহির রায়হানের কায়েতটুলির বাসায়। রফিক জহির রায়হাননের পূর্ব পরিচিত, ইউসিসে চাকুরী করতেন। টেলিফোনে রফিক বলেছিলো, আপনার বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সার মিরপুর বারো নম্বরে বন্দী আছেন। যদি বাঁচাতে চান এক্ষুণি মিরপুর চলে আসুন। একমাত্র আপনিই তাঁকে বাঁচাতে পারবেন।

টেলিফোন পেয়ে জহির রায়হান দুইটি গাড়ী নিয়ে মিরপুরে রওনা হয়েছিলেন, তাঁর সাথে ছিলেন ছোট ভাই জাকারিয়া হাবিব, চাচাত ভাই শাহরিয়ার কবির, বাবুল, আব্দুল হক, নিজাম ও পারভেজ। মিরপুর ২ নং সেকশনে পৌছার পর সেখানে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে, জহির রায়হানের টয়োটা গাড়ি সহ থাকতে বলে অন্যদের ফেরত পাঠিয়ে দেন। শাহরিয়ার কবির অন্যদের নিয়ে বাড়ী ফিরে আসেন।

জহির রায়হান ভাইয়ের সন্ধানে মীরপুরে গেলে সেখান থেকে আর ফিরে আসেন নি। ১৯৭২ এর ৩০ জানুয়ারির পর তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। মীরপুর ছিলো বিহারী অধ্যুষিত এলাকা। এভাবেই মীরপুরে জহির রায়হান চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিলেন। অথচ সেদিন বিকেলেই প্রেসক্লাবে তাঁর কাছে থাকা অনেক দুর্লভ তথ্য প্রমান ফাঁস করার কথাছিল। যা প্রকাশ করলে অনেক তথ্য উম্মোচিত হতো যা আর কোনদিন উন্মোচিত হলো না।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে জহির রায়হান প্রত্যক্ষ ভাবে অংশগ্রহন করেছিলেন, তখন বেশ কয়েক জন ছাত্র, জনতা গ্রেফতার হয়েছিলেন, জহির রায়হান সেই কয়েক জনের মধ্যে একজন ছিলেন। সেই সময়ের তাঁর ভাষা আন্দোলন অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি ‘পোস্টার’ নামে একটি গল্প এবং সাড়াজাগানো উপন্যাস ‘আরেক ফাগুন’ লিখেছিলেন।

১৫২.

মুক্তিযুদ্ধে অসীম অবদানের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন শেখ মুজিরব রহমান। তাঁর আগমনকে সম্মান জানানোর জন্য রেসকোর্সে নৌকার অাদলে একটি মঞ্চ নির্মাণ করেছিলেন ইন্দিরা মঞ্চ।

আমি তারেক রাগীব রেখায়ন থেকে গিয়ে সেই মঞ্চ নির্মাণ দেখেছি, আর অপেক্ষা করছি কবে দেখবো নেহেরু কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে। আবশেষে এলো সেই দিন, ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ঢাকায় রাস্ট্রীয় সফরে এলেন ইন্দিরা গান্ধী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমাদের নিত্যকার খবর ছিলেন তিনি, তাঁর সদিচ্ছা, দূরদর্শিতা, দৃঢ়তা, সহমর্মিতা, আমাদের মোহাচ্ছন্ন করেছিলো আজ দেখবো বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুৃকে। বিকেলে যথারীতি চলে যাই রেসকোর্স লোকে লোকারণ্য। খুব কাছ থেকে দেখি তাঁকে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফর ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দুই দেশের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের বিশাল অবদান এবং ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ ভূমিকার জন্য তাঁকে এই সংবর্ধনা জানানো হয়েছিলো।

ঐতিহাসিক রেসকোর্সে বিশেষভাবে নির্মিত ইন্দিরা মঞ্চে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে মুজিব এবং ইন্দিরা সভায় আগত অসংখ্য মানুষকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।

করতালিমুখর সর্বস্তরের জগগণ দুই অবিসংবাদিত নেতাকে অভিনন্দন জানিয়ে ছিলেন। এক মঞ্চে একসঙ্গে স্বাধীনতার দুই কাণ্ডারিকে দেখে সমবেত দর্শকরা উল্লাসে ফেটে পড়েছিলো। ভীষণ ভালোলেগে ছিলো বুদ্ধিদিপ্ত উজ্জ্বল ইন্দিরা গান্ধীকে দেখে।

সেদিন ছিলো শেখ মুজিবের জন্মদিন। ইন্দিরা গান্ধী দিলেন আমাদের শ্রেষ্ঠ উপহার। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করার ঘোষণা করে।

শাহবাগের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইন্দিরা গান্ধীকে রাজকীয় সংবর্ধনার পাশাপাশি মুজিব-ইন্দিরার মধ্যে ১৯ মার্চ ২৫ বছরের একটি দ্বিপক্ষীয় মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিলো। চুক্তির মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তাঁদের এসব চুক্তি দুই দেশের মৈত্রী ও সহযোগিতা আরো দৃঢ ভিত্তি পেয়েছিলো। এটি একটি যুগান্তকারী চুক্তি, বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের জন্য সব রকম সাহায্য-সহযোগিতা ও দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় সেই চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত ছিলো।

ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এলেও শেখ মুজিবের পরিবারের সঙ্গে তাঁর কিছুটা সময় আবেগঘনভাবে কাটিয়ে ছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ি যান এবং সেখানে পুরো পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কাটিয়েছেন আন্তরিক সময়।

ইন্দিরা গান্ধী আমাদের কাছে একজন সাক্ষাৎ দেবী।

১৫৩.

বাংলাদেশ স্বাধীন হলে উপমহাদেশের তিনটি ভারত পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কতগুলো তীব্র সমস্যায় পতিত হয়েছিলো। তিন দেশে প্রায় অর্ধ কোটির বেশী নাগরিক প্রত্যক্ষ ও পরক্ষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। বাংলাদেশে ১৯৪৭ সালের বিহারী রিফিউজিরা বাংলাদেশ প্রতি অানুগত্য প্রকাশ করেনি ওরা পাকিস্তান চলে যেতে আগ্রহী।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে চলছে আনন্দোৎসব, অন্যদিকে দেশভাগ নিয়ে পাকিস্তানের জনগণ মাঝে চলছে তীব্র অসন্তোস। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতাচ্যুত বন্দী অবস্থায় পাকিস্তানের জনগণ গাড়ি থেকে নামিয়ে প্রকাশ্যে জুতাপেটা করেছিলো ইয়াহিয়াকে। এমন অবস্থায় ক্ষমতায় বসেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো। স্বাভাবিক ভাবে ভুট্টোর উপর দেশের সকল দায় দায়িত্ব বর্তায়, বিশেষ করে ভারতে বন্দী পাকিস্তানের প্রায় ৯৩ হাজার সৈন্য, জনগণের তীব্র ক্ষোভের মুখে ভুট্টো ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়েছিলেন। ভারতের সঙ্গে এক বৈঠকের বার্তা পাঠিয়েছিলেন ভূট্টো নিজেই।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী জেনেভা কনভেনশন নীতি অনুযায়ী ১৬ ডিসেম্বর, ঢাকার রেসকোর্সে আত্মসমর্পণ করলে যুদ্ধবন্দী হিসেবে ভারত তাদের নিরাপত্তা দিয়ে ভারতে নিয়েগিয়েছিলো। বাংলাদেশ সরকার ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে বদ্ধপরিকট। এই নিয়ে ভুট্টো নিজদেশে ভীষণ চাপের মুখে।

পাকিস্তানে আটকা পড়েছে লাখ লাখ বাংলাদেশী তেমনি বাংলাদেশেও লাখ লাখ পাকিস্তানী আটকা পড়েছে। উপমহাদেশে এমন অস্থিতিশীল অবস্থায় আগে আর কখনও পরেনি। ভারতে বন্দী সৈন্যদের মুক্তি এবং যুদ্ধবন্দী হিসেবে তাদের বিচার রহিতকরণ ছিল পাকিস্তান সরকারের জন্য একটি অতিজরুরী বিষয়। তেমনি একটি শান্তিকামী জাতি হিসেবে ভারত তার ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখতে পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা জন্য আগ্রহী ছিলো।

এই প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সিমলায় ১৯৭২ সালের ২৮ জুন এক বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন। দীর্ঘ আলোচনা অনেক বাকবিতর্কের পর ২ জুলাই রাতে দুই দেশ একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন যা সিমলা চুক্তি নামে অবহিত। ভুট্টো কন্যা বেনজীর ভুট্টো সিমলায় পিতার সাথে গিয়েছিলেন।

দুই দেশ থেকে অনেক ডেলিগেট সিমলায় গিয়েছিলেন। চলবে………….।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here