বাংলাদেশ নারী ও কিশোরীরা প্রতিদিন যে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, তার এক করুণ পরিসংখ্যান সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ (বিএমপি) প্রকাশিত একটি অর্ধ-বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মোট ১ জাকার ৫৫৫ জন নারী ও কিশোরী সহিংসতার শিকার হয়েছেন। দেশের ১৫টি জাতীয় দৈনিক থেকে সংগৃহীত এই তথ্য শুধু সংকটের ব্যাপকতাই নয়, নারীদের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতাকেও প্রকাশ করছে।
পরিসংখ্যান এক নজরে
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন ২০২৫) নারী ও কিশোরীদের ওপর সহিংসতার ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। পরিসংখ্যান অনুসারে, এই সময়ে মোট ১ হাজার ৫৫৫ জন নারী ও কিশোরী বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৪৮১টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ৩৪৫ জন শিশু। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১০৬টি, এর মধ্যে ৬২ জন শিশু। ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৭টি, যার মধ্যে ১০ জন শিশু।
এছাড়া, খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩২০টি, যার মধ্যে ৬১ জন শিশু। কেবল জুন মাসেই ২০৩ জন নারী ও কিশোরী সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ৬৫টি, যার মধ্যে ৪৩ জন শিশু। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৮টি, এর মধ্যে ৫ জন শিশু। ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৩টি, যার মধ্যে ২ জন শিশু। এছাড়া, শিশুদের ওপর ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ৭টি। এই সংখ্যাগুলো যত ভয়ঙ্করই হোক না কেন, বাস্তব চিত্র হয়তো আরও ভয়াবহ। কারণ সামাজিক কলঙ্ক আর নীরবতার কারণে অনেক ঘটনাই প্রকাশ্যে আসে না।
কেন এই প্রতিবেদন গুরুত্বপূর্ণ
বিএমপির প্রতিবেদন কেবল অপরাধের পরিসংখ্যান নয়—এটি আমাদের সমাজের গভীর কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক সমস্যার প্রতিফলন। সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো শিশুদের বিপুল অংশ ভুক্তভোগী হওয়া, যা লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার এক নৃশংস প্রবণতাকে উন্মোচন করে।
এ ধরনের প্রতিবেদন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে: ক) এমন এক সমাজে সহিংসতার প্রকৃত সংখ্যা নথিভুক্ত করা, যেখানে বহু ঘটনা রিপোর্টই হয় না। খ) নীতিনির্ধারকদেরকে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে চাপ সৃষ্টি করা। গ) নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করা।
সংখ্যার বাইরের কারণগুলো
সহিংসতার এই চক্রকে চালিত করছে কয়েকটি আন্তঃসংযুক্ত কারণ: ১) আইন প্রয়োগের দুর্বলতা – নারীনির্যাতন দমন আইনসহ কঠোর আইন থাকলেও দোষীদের শাস্তি দুর্লভ, আর বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হয়। ২) সামাজিক কলঙ্ক ও ভিকটিম-ব্লেমিং – ভুক্তভোগীরা লজ্জা ও বঞ্চনার ভয়ে অভিযোগ করতে অনীহা দেখান। ৩) পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে অনেকে পুরুষের সহিংসতাকে ছোট করে দেখে বা মেনে নেয়। ৪) দণ্ডমুক্তি ও রাজনৈতিক প্রভাব – অপরাধীরা, বিশেষ করে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা, প্রায়শই দায়মুক্তি পেয়ে যান।
এই প্রতিটি সংখ্যার পেছনে আছে একটি ভেঙে পড়া পরিবার, একটি স্তব্ধ হয়ে যাওয়া শিশু কিংবা অকালেই নিভে যাওয়া জীবনের গল্প। যারা বেঁচে থাকেন তারাও বয়ে বেড়ান অদৃশ্য ক্ষত—আঘাত, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা আর হারিয়ে যাওয়া সুযোগ। শিশু ভুক্তভোগীদের জন্য এই প্রভাব আরও ভয়াবহ, যা তাদের পুরো জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়।
এই প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান নিছক সংখ্যা নয়। এগুলো এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সাক্ষ্য বহন করে, যা প্রতিদিনের জীবনের অংশ হয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে।
 
		