দেশজুড়ে মবের ছড়াছড়ি

0
12

কারবালার ময়দানে ইমাম হোসেন (রাঃ)-কে হত্যা করার সময় তাঁর প্রতিপক্ষ শিবিরের কিছু নামাজী সৈনিক দ্রুত তাঁর শিরচ্ছেদ করার জন্য চাপ দিচ্ছিল, যেন আসরের নামাজের সময় পার হয়ে না যায়। কারণ তারা হয়তো এটিও চিন্তা করেনি যে তারা নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিবারের একজন সদস্যকে হত্যা করছে। এখন বাংলাদেশেও দেখা যাচ্ছে সেই বর্বর চিত্র। কোথাও মব করার আগে পড়া হয় নামাজ। ওড়ানো হয় ফিলিস্তিনি পতাকা। এরপর চালানো হয় আক্রমণ। এতে সমাজে ছড়িয়ে পড়ে ফিৎনা। 

এইতো কিছুদিন আগেও বিএনপি থেকে পদ হারানো বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমানের বাড়ির সামনে তাকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করা হয়। সেখানে মব করানোর জন্য কিছু নারীও সামনে রাখা হয়। সেই নারীদের সঙ্গে আবার খোশ গল্প করতে দেখা যায় ধর্মীয় লেবাস পরা একজনকে। বাংলাদেশে এখন নতুন এই ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে কোনো আন্দোলন বা বিশৃঙ্খলা করার আগে লোকজন নামাজ আদায় করে নেয়। তারা কোনো আন্দোলন হলেই ফিলিস্তিনি পতাকা ওড়ায়। 

একসময়ের তুখোড় ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম ফেসবুক পোস্টে ফিলিস্তিনিদের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে বলেছিলেন, তার ইচ্ছা মসজিদুল আকসায় গিয়ে ফিলিস্তিনি ভাইদের সঙ্গে গিয়ে নামাজ আদায় করবে। এই সার্জিস আলমরাই যখন কিংস পার্টি হওয়ার পর ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়া আমেরিকান দূতাবাসে গিয়ে বসে থাকে তখন তাদের প্রতারণা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় না। 

তাদের তথাকথিত সেই ধর্ম বেঁচে খাওয়ার প্রবণতাই আজ বাংলাদেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ফিলিস্তিনির পতাকা শাহবাগে ওড়ালেও এই পতাকা কখনোই মার্কিন দূতাবাসের সামনে গিয়ে ওড়ানো হয়নি। আর ওইদিকে তথাকথিত তৌহিদি জনতার নামে আক্রমণ চলছেই। শুক্রবার (৫ আগস্ট ) রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরুল হক ওরফে ‘নুরাল পাগলার’ মরদেহ তুলে নিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে উগ্রপন্থীরা জনতা। এর আগে সেখানকার দরবার শরিফ ও বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন বিক্ষুব্ধরা। এতে দরবারের ভক্ত, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশসহ ৫০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। রাজশাহীর পবা উপজেলায় জুমার নামাজের পর একটি খানকা শরিফে হামলা ও ভাঙচুর করেছে একদল লোক।  এসব তথ্য আবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছড়াতে সহায়তা করে জামায়াতের বটবাহিনী। তারা এই তথাকথিত তৌহিদি জনতার পক্ষে খবর প্রচার করতে তৎপর থাকে। 

রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিচারাধীন জঙ্গিদের জামিনে মুক্তি, প্রশাসনের দুর্বল নিয়ন্ত্রণ এবং ধর্মের নামে অপপ্রচার—সব মিলিয়ে দেশের সামাজিক বুননকে ক্রমেই দুর্বল করে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আগেই সাবধান করেছিলেন, জঙ্গিবাদ ও ধর্মীয় উগ্রতা শুধু সশস্ত্র গোষ্ঠী নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনেও জায়গা করে নিতে পারে এবং সেই শঙ্কাই এবার বাস্তবে রূপ নিয়েছে।

বরিশালের গৌরনদী উপজেলায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এক ঘটনা সেই ভয়াবহ বাস্তবতার প্রমাণ। গৌরনদীর জঙ্গলপট্টি গ্রামের বাসিন্দা রাম কৃষ্ণ দে’র বাড়ির মন্দিরে প্রবেশ করে এক কিশোর দুটি প্রতিমা ভাঙচুর করে পালানোর চেষ্টা করে। স্থানীয়রা কিশোরটিকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন। এই ঘটনায় শুধু ধর্মীয় সহিংসতাই নয়, বরং শিশুদের মধ্যেও উগ্রবাদী মনোভাব ছড়িয়ে পড়ার গভীর সংকেত মিলেছে। এলাকাবাসী এবং বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি ইউনূস সরকারের অধীনে ছড়ানো নীরব ধর্মীয় উগ্রতার ফল।

কারা কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে অন্তত ৩০০ জনের বেশি জঙ্গি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জামিনে রয়েছেন। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে, বিশেষ করে সন্ত্রাসের শিকার পরিবারগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

এই প্রেক্ষাপটে মালয়েশিয়ায় নিরাপত্তা বাহিনী ৩৬ জন বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করেছে, যাদের ‘উগ্র জঙ্গি আন্দোলনে’ জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। দেশটির গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণা, গ্রেপ্তারকৃতদের কেউ কেউ বাংলাদেশে সরকার পতনের ষড়যন্ত্রে সম্পৃক্ত।মালয়েশিয়ার পুলিশ প্রধান এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, গ্রেপ্তারকৃত একটি জঙ্গিগোষ্ঠী সিরিয়া ও বাংলাদেশে আইএস সেলগুলোকে অর্থ সহায়তা দিতে অর্থ সংগ্রহ করছিল। স্পেশাল ব্রাঞ্চের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের তদন্তে দেখা যায়, তারা সদস্য ফি ও দাতব্য অনুদানের মাধ্যমে তহবিল গড়ে তুলছিল।

বিদেশি জঙ্গি সংগঠনের ‘বাংলাদেশ ভূমিকা’ স্বীকার

পাকিস্তানের গুজরানওয়ালায় লস্কর-ই-তৈয়বার নেতা মুজাম্মিল হাজমি সম্প্রতি দাবি করেছেন, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনে তাদের সংগঠনের ভূমিকা ছিল। এই দাবি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর গভীর প্রশ্নচিহ্ন তুলেছে, যা বিশ্লেষকরা বহিরাগত ষড়যন্ত্রের প্রমাণ হিসেবে দেখছেন। এই ঘটনা দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, লস্কর-ই-তৈয়বার মতো একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের এই দাবি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত বহন করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “এই ধরনের দাবি শুধু উদ্বেগজনকই নয়, এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং জনগণের ইচ্ছার ওপর বহিরাগত প্রভাবের বিপজ্জনক প্রমাণ। সরকারের পতনের পেছনে যদি সত্যিই বিদেশি জঙ্গি সংগঠনের হাত থাকে, তবে এটি দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতার ইঙ্গিত।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, “লস্কর-ই-তৈয়বার এই দাবি সরকার এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য একটি জাগরণ ঘণ্টা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রভাব মেনে নেওয়া যায় না। এটি শুধু সরকারের পতন নয়, দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি হুমকি।” তিনি সরকারের নিষ্ক্রিয়তা এবং তদন্তে দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়ার সমালোচনা করেন।

সরকারের দায়সারা বিবৃতি 

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নিজেকে ‘ইমাম মাহদি’ দাবি করা নুরুল হক ওরফে নুরা পাগলার মরদেহ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাকে অন্তর্বর্তী সরকার ‘অমানবিক ও জঘন্যতম অপরাধ’ আখ্যা দিয়ে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) সরকারের প্রেস উইং থেকে জারি করা এক বিবৃতিতে এই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হয়। তবে বিশ্লেষকরা এই বিবৃতিকে ‘দায়সারা’ ও ‘প্রকৃত পদক্ষেপের অভাবে ফাঁকা বুলি’ হিসেবে সমালোচনা করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “এ ধরনের বিবৃতি জনগণের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য দেওয়া হয়, কিন্তু বাস্তবে এর পেছনে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ থাকে না। এই ঘটনার তদন্তে স্বচ্ছতা ও জড়িতদের দ্রুত বিচার না হলে সরকারের প্রতিশ্রুতি শুধুই কথার কথা হয়ে থাকবে।” তিনি আরও মনে করেন, এ ধরনের ঘটনা সমাজে ধর্মীয় উন্মাদনা ও অরাজকতার প্রতিফলন, যা প্রতিরোধে সরকারের ব্যর্থতা স্পষ্ট।

স্থানীয় সাংবাদিক রহিম মিয়া বলেন, “এই ঘটনা শুধু নুরা পাগলার মরদেহের প্রতি অবমাননাই নয়, বরং আইনশৃঙ্খলার সম্পূর্ণ ভাঙনের চিত্র। সরকারের বিবৃতিতে কঠোর শাস্তির কথা বলা হলেও, এখন পর্যন্ত কোনো গ্রেপ্তার বা তদন্তের অগ্রগতির খবর পাওয়া যায়নি। এটি জনমনে সরকারের প্রতি অবিশ্বাস তৈরি করছে।”

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই ঘটনার পর সরকারের উচিত ছিল তাৎক্ষণিকভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করে জড়িতদের গ্রেপ্তারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্তু শুধুমাত্র বিবৃতি প্রকাশের মাধ্যমে সরকার দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তারা সরকারের কাছে দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

মবের পক্ষে সরকার 

জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলীয় নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, “মব নয়, এটা জনরোষ। যারা বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করেছে, তাদের বিচার না হওয়াতেই এই ক্ষোভ।”

সাবেক বিএনপি নেতা ও বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, “মবের ঘটনাগুলো বিচার বিভাগের প্রতি অনাস্থা নয়, বরং গত ১৭ বছরের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।” তার এই বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা, যাদের মতে, এমন মন্তব্য রাষ্ট্রীয় সহিংসতাকে বৈধতা দেয়।

২৬ জুন রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক সেমিনারে প্রেস সচিব বলেন, “বলা হচ্ছে মব তৈরি হচ্ছে, আমি এটাকে মব বলছি না, বলছি প্রেসার গ্রুপ। সেটা তৈরি হচ্ছে সাংবাদিকতার ব্যর্থতার কারণে। তিনি অভিযোগ করেন, ১৫ বছরের সরকারে থাকা অবস্থায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ এবং রাষ্ট্রীয় হিংস্রতা জন্ম দিয়েছে বর্তমান ‘ভয়ের সংস্কৃতি’। এর মধ্যে এক ধরনের জনরোষ জমে উঠে মব হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে।

বাংলাদেশ এখন এক ধরনের হাইব্রিড অরাজকতার মুখোমুখি—যেখানে প্রোপাগান্ডা, গুজব, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “সন্ত্রাস যে করে, তার ঘৃণা যেন তৃণসম দহে”—এই নীতিতে ফিরতে না পারলে সহিংসতা আরও বাড়বে, আর গণতন্ত্র আরও সংকুচিত হবে।

প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, মিডিয়া ও নাগরিক সমাজ—সব পক্ষের এখন প্রয়োজন সচেতনতা, দায়িত্বশীলতা ও দ্রুত পদক্ষেপ। নইলে, এই ‘মব’ ও জঙ্গিবাদ কেবল দুটি শব্দ নয়—এটি হয়ে উঠবে জাতির ভবিষ্যতের অভিশাপ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here