সংসদ পাস না করলে সংস্কার হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে

0
3

রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরিত জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে– এ-সংক্রান্ত সুপারিশ আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় সরকারকে দেবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন সূত্র জানিয়েছে, আগামী সংসদে গঠিত ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ ৯ মাসের মধ্যে সংস্কার করবে। অন্যথায় জুলাই সনদ অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধান সংশোধন হবে– এমন বিকল্প সুপারিশ থাকতে পারে। গতকাল সোমবার যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ও ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে সুপারিশ এবং ‘জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান সংস্কার) আদেশ-২০২৫’ খসড়া তুলে ধরা হয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং কমিশনের এই বৈঠককে সমাপনী বলে আখ্যা দিয়েছে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।

কমিশন সূত্র জানিয়েছে, আদেশের খসড়ায় বাস্তবায়নের দুটি বিকল্প থাকতে পারে। প্রথমটি হবে, ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ ৯ মাসের মধ্যে সাংবিধানিক সংস্কার করতে বাধ্য থাকবে। বিকল্প সুপারিশ হবে, এই সময় অতিক্রান্ত হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধান সংস্কার হবে।

যমুনার বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, গণভোটের আগেই সরকার জুলাই সনদ অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের খসড়া বিল তৈরি করবে। গণভোটে অনুমোদিত আদেশ অনুযায়ী পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার না করতে পারলে, বিল পাস বলে গণ্য হবে।

১৭ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে থাকা সংস্কারের ৮৪ সিদ্ধান্তের মধ্যে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনসহ ৯ মৌলিক সংস্কারে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) রয়েছে। যমুনার বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, খসড়া আদেশে বলা থাকবে যেসব সংস্কারের সিদ্ধান্তে ঐকমত্য রয়েছে সেগুলো হুবহু অনুমোদন দেবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ। যেগুলোতে ভিন্নমত রয়েছে, সেগুলো পরিষদ আলোচনা করে গ্রহণ করবে বা বাদ দিতে পারবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সবচেয়ে বেশি বিরোধ পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন নিয়ে। বিএনপি পিআরের ঘোর বিরোধী। জামায়াত, এনসিপিসহ বাকিরা অন্তত উচ্চকক্ষে পিআর চায়। যমুনার বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, গণভোটে আদেশ অনুমোদিত হলে পরিষদে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব উঠবে। সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তা অনুমোদিত হলে, ৯ মাসের মধ্যে উচ্চকক্ষ গঠন প্রক্রিয়া শুরু হবে। এবারের নির্বাচনে উচ্চকক্ষের জন্য আগাম প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করতে হবে না। তবে আগামী নির্বাচন থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনের আগেই উচ্চকক্ষের ১০০ প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করতে হবে।

যদিও কমিশন সূত্র বলেছে, উচ্চকক্ষে পিআরের বিষয়ে বিশেষ শর্ত থাকবে আদেশে। তা হবে, গণভোটে আদেশ অনুমোদিত হলে, পরিষদ উচ্চকক্ষ গঠনের অনুমোদন দিতে বাধ্য থাকবে। অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে, সুপারিশের এই শর্তে পরিবর্তন আনতে পারে। তবে কমিশন রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য এই শর্তকে জরুরি মনে করে।

কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, মঙ্গলববার সরকারপ্রধানের কাছে সুপারিশ জমা দেবে কমিশন। এরপর সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানানো হবে। গণভোট কবে হবে এবং ‘জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান সংস্কার) আদেশ’ কে জারি করবে–এ সংক্রান্ত সুপারিশ কমিশন করবে না বলে জানা গেছে। একজন সদস্য জানান, এই দুই সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে হবে।

কমিশন সূত্র জানিয়েছে, জুলাই সনদ হবে আদেশের অংশ। সনদ নয়, আদেশের ওপর হবে গণভোট। গণভোটে আদেশটি অনুমোদিত হলে, আগামী সংসদের দ্বৈত ভূমিকা থাকবে। নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত হবে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’।

কমিশন সূত্র জানিয়েছে, সংসদ এবং পরিষদ একই সঙ্গে কাজ করবে। সংসদের স্পিকার হবেন পরিষদের সভাপতি। সরকার গঠন, আইন ও বাজেট প্রণয়নের মতো নিয়মিত কাজ করবে সংসদ। পরিষদ জুলাই সনদে থাকা সংস্কার বাস্তবায়নের সংবিধানের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংশোধন করবে। এ জন্য গণভোটের মাধ্যমে পরিষদকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের ক্ষমতা তথা কন্সটিটুয়েন্ট পাওয়ার দেওয়া হবে।

বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ক্ষমতা বলে আদেশ জারি করার সুপারিশ করতে যাচ্ছে কমিশন। যদিও বিএনপি সাংবিধানিক আদেশ জারির বিরুদ্ধে। দলটির অবস্থান হলো, বিদ্যমান আইনে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচনের দিনে গণভোট আয়োজন সম্ভব। জামায়াত এবং এনসিপি সনদকে আইনি ভিত্তি দিয়ে নির্বাচনের আগে গণভোট দাবি করছে।

কমিশন সদস্যরা জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টাকে বলা হয়েছে, অভ্যুত্থানের ক্ষমতাবলে জারি করা আদেশই হবে আইনি ভিত্তি। গণভোটে জনগণকে প্রশ্ন করা হবে, ‘আপনি আদেশ সমর্থন করেন?’ ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ভোটে মতামত জানাবেন ভোটাররা। প্রধান উপদেষ্টা এতে একমত হয়েছেন।

জুলাই সনদের ৮৪ সিদ্ধান্তের ৫৮টিতে কোনো না কোনো দলের ভিন্নমত রয়েছে। পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন পদ্ধতি, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগসহ মোট ১৫ সিদ্ধান্তে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। জামায়াতের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে ৭ সিদ্ধান্তে।

বিএনপি দাবিতে সনদে নোট অব ডিসেন্ট অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিএনপির ভাষ্য, যে দলের যে সংস্কারে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে, ক্ষমতায় গেলে তা বাস্তবায়ন না করার এখতিয়ার রাখবে। যদিও জামায়াত, এনসিপি গণভোটে নোট অব ডিসেন্ট চায় না। দল দুটির দাবি, গণভোটে অনুমোদিত হলে পুরো সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। এ কারণে এনসিপি সনদে সই করেনি।

যমুনার বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, পুরো সনদই সংবিধান সংস্কার পরিষদে যাবে। উদাহরণ দিয়ে সূত্রটি বলেছে, যেমন প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ ১০ বছরে সীমাবদ্ধ করার বিষয়ে সব দলের ঐকমত্য রয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী একাধিক পদে থাকতে পারবেন না– এ সিদ্ধান্তে কয়েকটি দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। পরিষদে যদি তারা প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তবে তারা পরিবর্তন করতে পারবে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কমিশনের সব নথি, আলোচনার ভিডিও, অডিও, ছবি সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, এগুলো মহামূল্যবান সম্পদ। জাতি হিসেবে আমরা কোন প্রেক্ষাপটে কী প্রক্রিয়ায় কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম, তা সবার জন্য দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং উন্মুক্ত থাকা দরকার।

বৈঠকে সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা চূড়ান্ত করার পাশাপাশি অন্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নেও সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি আইন বিশেষজ্ঞ, বিচারপতি, শিক্ষাবিদসহ নাগরিক সমাজের বিশিষ্টজনের সঙ্গে আলোচনায় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ চূড়ান্ত করা হয়েছে। ঐকমত্য কমিশনের প্রধান দায়িত্ব ছিল সংস্কারের একটি রূপরেখা তৈরি করা। মিল-অমিল সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তারা দিনের পর দিন ধৈর্য ও বিচক্ষণতার সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়েছে। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও কমিশন সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সনদ বাস্তবায়নে সবাই সরকারের নিবিষ্টতা ও সাহসিকতা প্রত্যাশা করে।

কমিশন সদস্য ড. ইফতেখারুজ্জামান জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বলেন, শহীদ পরিবার বলছে, সংস্কার নিশ্চিত না হলে তাদের সন্তানদের জীবন উৎসর্গ করা বৃথা যাবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here