হাফিজুর রহমান: এমন কোন বিখ্যাত মানুষ আমি নই যার স্মৃতিকথা না থাকলে পৃথিবী রসাতলে যাবে। তবু যে লিখছি, তার কারণ বোধকরি দ্রুত-চলমান সময়। বিংশ-শতাব্দীর মধ্যকাল থেকে এখন পর্যন্ত যে জটিল-ঋজু-কঠিন আবার উপভোগ্য অভিজ্ঞতা বুকে নিয়ে এগিয়েছি, তার কিছুটা পাঠকের কাছে তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই এই প্রয়াস।
৬.
দেশের সামগ্রিক অবস্থা যে ক্রমশ: খারাপের দিকে এগুচ্ছিল, ছোট হলেও একটু-আধটু যে বুঝতাম না, তা নয়। সুদর্শন পাকিস্তানি হিটলার আইউব খানের বিরুদ্ধে গণ-মানুষের ক্ষোভ দানা বাঁধছিল। আইয়ুবের রাজনীতি-সংকোচনের নীতির বিরুদ্ধে গড়ে উঠছিল আন্দোলন। ডুমুরিয়ার মতো তৎকালের যোগাযোগবিহীন জনপদেও সভা-সমিতি জোরদার হয়ে উঠছিল।
তেমনি একটি পথ-সভার কথা ভুলিনি এখনো। আব্বা এইসব উদ্যোগে সম্পৃক্ত ছিলেন বলেই ওই সভায় শুধু যে উপস্থিত ছিলাম, তাই নয়, সভার প্রধান অতিথি যুবক শেখ মুজিবর রহমান-এর গলায় মালাও দিয়েছিলাম। তিনি আমাকে গাল টিপে দিয়ে আব্বাকে বলেছিলেন, হামিদারসাহেব, আপনার ছেলেটা এত চুপচাপ কেন! আমাকে বলেছিলেন, বড়ো হয়ে দেশ-সেবা করবে তো খোকা?
ঘাড় নাড়িয়ে বলেছিলাম, জ্বী। আব্বা কী বুঝেছিলেন জানিনা। তবে বয়সে যতো বেড়ে উঠেছি, বঙ্গবন্ধুর সেই কথাটা আমাকে নাড়া দিয়েছে বারবার। রাজনীতিতে নামিনি ঠিকই, তবে দেশের মানুষের কল্যাণ-ভাবনাকে কখনোই অগ্রাধিকার না দিয়ে পারিনি।
বর্তমান কালীবাড়ি-সংলগ্ন তৎকালিন সিএন্ডবি’র মাটির রাস্তার বাবলা-তলায় অনুষ্ঠিত ওই সভায় অন্যান্যদের মধ্যে খুলনার বিশিষ্ট রাজনীতিক-সাহিত্যিক এ এফ এম আব্দুল জলিল সাহেবও উপস্থিত ছিলেন। পুরনো রেজিস্ট্রি-অফিসের মাঠেও কয়েকটি সভার কথা মনে পড়ে।
সারাদেশের বাতাস এভাবে ডুমুরিয়াতেও বইতে শুরু করেছিল। আমরা তার কিছু আঁচ টের পাচ্ছিলাম। যদিও সবকিছু বুঝে ওঠার সাধ্যি তখনো একেবারে অনায়াত্ত। মূলত: এসএসসি পরীক্ষার পূর্বে স্বাধীনভাবে বাজারে আসবার অধিকার ছিলনা আমাদের। দুটি কারণে আসবার সুযোগ ঘটতো। এক. নতুন জামা-কাপড়ের মাপ দিতে ও চুল ছাটাতে। দুই. রোজার মাসে আব্বার সাথে বাজারে ইফতার করার বায়না ধরলে।
নইলে আমাদের পাড়ার মাঠ-ঘাট-বিল ছিল আমাদের বৈকালিক খেলাধুলার পীঠস্থান। বাড়ি থেকে বাজারের দূরত্ব মাইলখানেকের বেশি নয়। তবু স্কুল-ফাইনালের পূর্বে কতোদিন এই রাস্তাটুকু অতিক্রম করেছিলাম, চেষ্টা করলে এখনো হয়তো হাতে গুণে বলতে পারবো। তবে প্রয়োজনে ডুমুরিয়া থানা-কোয়ার্টারে বসবাসরত বন্ধুদের বাসায় আসতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি কখনো। আর প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার ব্যাপারে কোন বিধি-নিষেধের নিগড় একদমই ছিলনা। তবে এই সুযোগটির অসদ্ব্যবহারের কোন দুরাশার কথা কখনো ঠাঁই পায়নি মনে।
আব্বা তো ছিলেন সংসারের একরকম বহিরাঙ্গিক সদস্য। আব্বার কাছে মার খাওয়ার কোন স্মৃতি তো নেইই, এমনকি শাসন-ধমকের কথাও মনে করতে পারি নে। তবে অভাবটা শতগুণে পুষিয়ে দিতেন আম্মা।
মাগরিবের আযানের পূর্বে ঘরে ফিরে আসার স্থায়ী ছিল তাঁর। একদিনের কথা মনে পড়ে। পাশের বাড়ির সম্ম্পর্কীয় কোন এক দাদাদের বাড়িতে বিয়ের আয়োজন চলছিল। কাদামাটির মধ্যে বরের গা ধোয়ানোর মজা উপভোগ করতে গিয়ে কখোন যে সন্ধ্যা পেরিয়েছে, তা বুঝতেই পারিনি। এদিকে মা-জননী আমাকে ডাকতে ডাকতে হয়রান হয়ে রান্না-করার আম কাঠের চেলা নিয়ে আমার ফেরার মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ফিরবার মুহূর্ত থেকে দীর্ঘ কাছারি, বাড়ির উঠোন পেরিয়ে ঘরে ঢোকার মধ্যে আম-কাঁঠটা ভেঙে খানখান। স্বীকার করতেই হবে, সেসময়কার বৈরি পরিবেশের মধ্যে এজাতীয় বিধি-নিষেধের কাঠিন্য আমার আজকের আমিতে উপনীত হওয়ার পথ বেঁধে দিয়েছিল।
আব্বা খুবই চমৎকার বক্তৃতা করতেন। তাঁর হয়তো স্বপ্ন ছিল, আমিও তাঁর মতো বাগ্মী হয়ে উঠি। আমাদের বাড়ির পিছনে গাছ-গাছালিতে আকীর্ণ সুবিশাল বাগানে নিয়ে কথা বলা শিখাতেন। বলতেন, মনে করো গাছগুলো মানুষেরা সব। ওদের উদ্দেশে বলো, কী করলে আজ সারাদিন। সে বড়ো কঠিন পরিশ্রম-লব্ধ প্রশিক্ষণ। গাছগুলিকে মানুষ ভেবে অনর্গল কথা বলে যাওয়া যে কী কঠিন কর্ম ছিল, তা বর্ণনাতীত। আব্বা হয়তো ভিতরে ভিতরে চেয়েছিলেন, তাঁর সন্তান একদিন সভা মাতিয়ে ঝড় তুলবে মানুষের হৃদয়ে। আমি তার কিছুই হয়ে উঠতে পারিনি ঠিক। কিন্তু জীবনের যেটুকু সাফল্য, তার পিছনে আব্বার স্বপ্ন ও কার্যকর ভূমিকা কম ক্রিয়াশীল ছিল না।
আইয়ুবের বিরুদ্ধে ফাতেমা জিন্নার নির্বাচনের বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই আব্বা খুলনায় অবস্থান করছিলেন। আমরা কয়ভাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, ফাতেমা জিন্নাকে দেখতে ও বক্তব্য শুনতে খুলনায় যাবো। তখন খুলনায় যেতে গেলে দুই মাইল হেঁটে, ঘন্টাখানেক টাবুরে নৌকায় শুয়ে-বসে, তারপর খেয়া পার হয়ে বেবীট্যাক্সিতে উঠে দৌলতপুর যেতে হতো। তারপর খুলনার গাড়ি। তার চেয়ে সিএন্ডবি’র মাটির রাস্তা ধরাই উত্তম। প্রায় সারাদিন হেঁটে আমরা যখন খুলনার বিখ্যাত সার্কিট ময়দানে পৌঁছালাম, তখন সভায় সমাগত বিশাল জনসমুদ্র ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছে। অর্থাৎ সভা সমাপ্ত তখন।
আব্বা তখন হাসান সাহেবের নব-নির্মিত শাহীন হোটেলে থাকতেন। দুদিন বেড়িয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম, আব্বা তখন কী এক সম্মোহনী প্রশ্নের মুখামুখি এনে দাঁড় করালেন আমাকে, সেন্ট যাসেফস স্কুলে পড়বে আব্বা ? তোমাকে ক্লাস এইটে ভর্তি করে দেবো। আমি কিছু না বুঝেই বললাম, হ্যাঁ। পড়বো।
ছোট্ট-বেলার একটা ঘটনা মনে পড়লো। ওয়ান কি টু’তে পড়ি তখন। আমার দুই চোখে দিয়েই কিছুদিন-যাবত পানি ঝরছিল। চোখের ডালি বুজলেই কাটার মতো ফুটতো। খুলনায় না দেখিয়ে সোজা ঢাকায় নিয়ে গিয়ে তখনকার নামকরা চক্ষু-বিশেষজ্ঞ ডা. টি আহমেদ’কে দেখালেন। অনেক পরীক্ষার পরে ডাক্তার জানালেন, যে ওষুধ দিলাম, তাতে কমে যাবে। তবে সম্পূর্ণ সেরে উঠতে অপেক্ষা করতে হবে। কুড়ি-বছর বয়সের দিকে এই অসুবিধাটা থাকবেনা আর। ওষুধ চলতে থাকুক। ডাক্তারের কথায় আব্বাকে চিন্তিত মনে হলো। সেটা দেখেই সংযোজন করলেন, আমি তো ওষুধ দিলাম, সন্তুষ্ট হতে না পারলে কলকাতায় একবার দেখিয়ে আনতে পারেন। কলকাতার কথা বলতেই আমার হৃদয়-স্পন্দন বেড়ে গেল।
আল্লাহ’র দরবারে কতো যে দোওয়া করলাম, এই ওষুধে যেন না সারে । কলকাতায় যেন যাওয়া হয়।
আবারও স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম । শহরের নিয়নবাতির কারুকার্যময় আলোকমালার মনোহর চাকচিক্য। মনে হলো, শহরে পড়তে যাওয়া ও অবস্থান করার মতো সুখের ঘটনা কীইবা আছে আর !
পয়ষট্টি-সালে খুলনার সেন্ট যোসেফ্স স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হলাম অবশেষে। (চলবে)