ডিজিটাল বাংলাদেশ: একুশের পরে (শেষ)

0
365

মোস্তাফা জব্বার: কৌশল ৩ ডিজিটাল শিল্প ও অর্থনীত। শিল্প ও অর্থনীতির ডিজিটাল রূপান্তর শিক্ষা এবং সরকার ডিজিটাল কবার পর যা খুব দ্রুত ডিজিটাল হতে হবে তা হলো অর্থনীতি। শিল্প-কল কারখানা-ব্যবসা-বাণিজ্য যদি প্রচলিত ধারার বাইরে বের হতে না পারে তবে যেমন করে আমারে অব্যন্তরীণ বাজার অন্যের দখলে যাবে তেমনি আমরা প্রতিযোগিতায় দুনিয়াতে টিকে থাকতে পারবনা।

আজকের দুনিয়াতে ব্যবসা বাণিজ্য ডিজিটাল হওয়াটা নতুন কোন ঘটনাই নয়। শিল্প কল কারখানা যদি ডিজিটাল না হয় তবে সেটিও দুনিয়াতে টিকে থাকতে পারবেনা। এজন্য আমার কয়েকটি সুপারিশ হলো:
ক) ব্যবসার কেনাকাটা, লেনদেনে ডিজিটাল করতে হবে। একটি কাগজের মুদ্রাবিহীন বাণিজ্যব্যবস্থা থেকে একটি ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
খ) ব্যবসার ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটাল করতে হবে। প্রচলিত খাতা কলমের হিসাব-নিকাশ বা হাজিরা-বেতনকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তর করতে হবে।
গ) উৎপাদন ব্যবস্থার যেখানে যেখানে ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করা যায় সেখানে সেখানে ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স বা আইটি প্রযুক্তির সহায়তা নিতে হবে।
ঘ) ব্যবসার সাথে যুক্ত সকলকে ডিজিটাল শিক্ষায় শিক্ষত করতে হবে। সাধারণ শিল্পযুগের দক্ষতা দিয়ে যে ডিজিটাপল যুগের ব্যবসা-বাণিজ্য করা যাবেনা তা সবাইকে বুঝতে হবে এবং সবাইকে সেভাবে প্রশিক্ষিত করতে হবে।
ঙ) ব্যবসা বা শিল্পের ধরনকে সৃজনশীল খাতে প্রবাহিত করতে হবে। সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন ও আবিষ। কারকে ভিত্তি করে প্রচলিত পন্যকে সৃজনশীল পণ্যে রূপান্তর করতে হবে
চ) সরকারকে তার অর্থনৈতিক কর্মসূচি জ্ঞানভিত্তিক কর্মসূচিতে রূপান্তর করতে হবে। সরকারের সকল পরিকল্পনাও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিকে বিবেচনায় রেখে করতে হবে। আমরা যে ২০৪১ সালে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলবো এবং আমাদের অর্থনীতি যে জ্ঞানভিত্তিক অর্তনীতি হবে সেটি বিবেচনায় নিয়ে সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার যে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ছাড়া একটি উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন কখনও পূরণ হবেনা।

কৌশল ৪: ডিজিটাল জীবনধারা। ডিজিটাল জীবনধারা ও জন্মের ঠিকানায় রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হবে ডিজিটাল জীবনধারা গড়ে তোলা। দেশের সকল নাগরিককে ডিজিটাল যন্ত্র-প্রযুক্তি দিয়ে এমনভাবে শক্তিশালী করতে হবে এবং তার চারপাশে এমন একটি পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে যাতে তার জীবনধারাটি ডিজিটাল হয়ে যায়।

আমি এই কৌশলের জন্যও ছয়টি কর্ম পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করছি।
ক. দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারে সক্ষম প্রতিটি নাগরিকের জন্য কমপক্ষে ১ এমবিপিএস ব্যান্ডউইদথ সুলভ হতে হবে। দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে এই গতি নিরবচ্ছিন্নভাবে যাতে পাওয়া যায় তার ব্যবস্হা করতে হবে। একই সাথে দেশের সকল সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা-উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ, সরকারি অফিস-আদালত, শহরের প্রধান প্রধান পাবলিক প্লেস, বড় বড় হাটবাজার ইত্যাদি স্হানে ওয়াইফাই ব্যবস্হা চালু করতে হবে। অন্যদিকে রেডিও-টিভিসহ বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সকল ব্যবস্হা ইন্টারনেটে-মোবাইলে প্রাপ্য হতে হবে। প্রচলিত পদ্ধতির অফিস-আদালত-শিক্ষা ব্যবস্হার পাশাপাশি অনলাইন ব্যবস্হা গড়ে তুলতে হবে। বলা যেতে পারে এটি হবে ইন্টারনেট সভ্যতা।
খ. ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কল-কারখানা, কৃষি, স্বাস্হ্য সেবা, আইন-আদালত, সালিশ, সরকারি সেবা, হাট বাজার, জলমহাল, ভূমি ব্যবস্হাপনাসহ জীবনের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড ডিজিটাল করতে হবে। জনগণ যেন এসব সেবা তার হাতের নাগালে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পায় তার ব্যবস্হা করতে হবে।
গ. মেধাশিল্প ও সেবাখাতকে প্রাধান্য দিয়ে শিল্পনীতি তৈরি করতে হবে। দেশের সকল প্রান্তে জ্ঞানভিত্তিক শিল্প-ব্যবসা বাণিজ্যকে এভাবে বিকশিত করতে হবে যাতে জনগণ জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে সরাসরি অংশ নিতে পারে।
ঘ. দেশের সকল আইনকে জ্ঞানভিত্তিক সমাজের উপযোগী করতে হবে। মেধা সংরক্ষণ ও এর পরিচর্যার পাশাপাশি সৃজনশীলতাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
ঙ. ডিজিটাল বৈষম্যসহ সমাজে বিরাজমান সকল বৈষম্য দূর করতে হবে এবং রাষ্ট্রকে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্হানসহ জীবনের ন্যূনতম চাহিদা পূরণের সকল ব্যবস্হা গ্রহণ করতে হবে।
চ. বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোকে তার জন্মের অঙ্গীকারে স্হাপন করার জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার পাশাপাশি দেশকে জঙ্গীবাদ, ধর্মান্ধতা, সন্ত্রাস ইত্যাদির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে এবং একাত্তরের ঘোষণা অনুযায়ী দেশের নীতি ও আদর্শকে গড়ে তুলতে হবে।

দেশটা ডিজিটাল হলো কিনা তার প্যারামিটার কিন্তু ডিজিটাল জীবনধারা দিয়েই দেখতে হবে। ফলে এই কৌশলটির দিকে তাকিয়েই আমরা অনুভব করবো কতোটা পথ হেটেছি আমরা।

সার্বিক বিবেচনায় ডিজিটাল বাংলাদেশ বা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ কেবলমাত্র প্রযুক্তির প্রয়োগ নয়, এটি বস্তুত একটি রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলন। এর চূড়ান্ত লক্ষ্য একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ। ধর্মভিত্তিক জঙ্গী রাষ্ট্র গড়ে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়া যায়না। বরং ডিজিটাল বাংলাদেশ আন্দোলনটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রবাহমান ধারারই অংশ। এই ধারার দুই প্রান্তে যে দুই ধারার মানুষেরা অবস্হান করছে তার একটি সমীকরণ করা প্রয়োজন। খুব স্পষ্ট করে এটি বলা দরকার যে, এই রেখার একদিকে রয়েছে একাত্তরের পরাজিত শক্তি এবং অন্যদিকে রয়েছে একাত্তরের বিজয়ীরা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে লড়াই-এর এই মাত্রাটি জনগণের মাঝে তেমনভাবে স্পষ্ট করা সম্ভব হয়নি।

নিবন্ধটি শেষ করার আগে একটি প্রত্যয়ের বিষয় আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই। আমরা যে অবস্থাতেই থাকিনা কেন সারা দেশে দ্রুত গতির ফাইবার অপটিক্স এবং মোবাইল ব্যবব্যান্ড প্যোছাতে হবে। ২১ সালের মাঝেই এটি শতভাগ সম্পন্ন করতে হবে। অন্যদিকে ২১ সালে বাংলাদেশে ৫জি প্রচলন করতে হবে। আমাদের পরের পরিকল্পনাটি হবে হবে ৫জি নির্ভর। বস্তুত একুশ সালের পরের ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল ভিত্তি হবে ৫জি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here