একাত্তুরের সেপ্টেম্বরনামা (১১)

0
312

সালাহ উদ্দিন: একাত্তুরের ২৩ সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল রওয়ানা দেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের দাবীর পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষে ১৬ সদস্য প্রতিনিধিদলের ৮ জন নিউইয়র্ক যাত্রা করেন। এদের মধ্যে ২ জন সাবেক রাষ্ট্রদূত ৩ জন প্রতিনিধি ছিলেন। বিচারপতি সাইদ লন্ডনে তাদের সাথে একত্র হয়ে পরে নিউইয়র্কে যুক্ত হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাকি কয়েকজন সদস্য আগে থেকেই ছিলেন। শেষ মুহূর্তে দলে আবুল হোসেন মাহমুদ আলী অন্তর্ভুক্ত হন।

এদিকে, বিদেশে প্রচারনা শুরু করে পাকিস্তানী দূত।  ভারত সরকারের প্রোপাগান্ডা মোকাবেলায় পাকিস্তান সরকার বিভিন্ন দেশে ভ্রাম্যমাণ দুত পাঠানো শুরু করেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিভিন্ন দেশ সফরের পাল্টা পদক্ষেপ হিসাবে এদের পাঠানো হয়। ফ্রান্সে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত এসকে দেহলভি যান আফ্রিকান দেশগুলোতে।

তুরস্কে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ইফতেখার আলি মালিক যান ইউরোপীয় দেশগুলোতে। মিসরে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত আসলাম মালিক যাবেন ল্যাটিন আমেরিকান দেশসমুহে। জাতিসংঘে নিযুক্ত সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি মোহম্মদ খান যান কিছু দেশে যার নাম জানা যায় নি। আজাদ কাশ্মীর এর সাবেক প্রেসিডেন্ট সরদার ইব্রাহিম খান, করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আইএইচ কোরেশী, ভারতের হায়দ্রাবাদ রাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লায়েক আলী জাতিসংঘে প্রতিনিধিদলে থাকিয়া একই দায়িত্ব পালন করেন।

পূর্ব পাকিস্তানের ২ জন প্রখ্যাত সাংবাদিক এসজিএম বদরুদ্দিন, খোন্দকার আব্দুল হামিদসহ পশ্চিম পাকিস্তানের একজন সাংবাদিক আজিজ বেগ একই দায়িত্ব পালন করেন।

খোন্দকার আব্দুল হামিদ বিএনপি এর প্রতিষ্ঠাতা তাত্ত্বিক। তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক। ইত্তেফাক এ সাংবাদিকতা করেছেন। জিয়া ও সাত্তারের আমলে মন্ত্রীো হয়েছেন, ৭৯ এর সাংসদ। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হত্যা মামলার আসামী পরে আপোষে অব্যাহতি। স্বাধীনতা বিরোধীদের পুনর্বাসনের জনক। ৭৭ সালে একুশে পদক পান।

অন্যদিকে নৌ কমান্ডার একটি দল ছোট ছোট নৌকা নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের অফ পোর্টে শত্রু জাহাজে মাইন সেট করতে যান। লম্বা দূরত্ব কারণে তারা সফল হতে পারেন নি এবং অপারেশন বাতিল করে ফেরার পথে একজন কমান্ডো, মোহাম্মাদ হসেইন, ডুবে মারা যান। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা উপকুলে পাকসেনাদের কোস্টাল নেভি আক্রমণের জন্য ৩ জন কমান্ডোর সমন্বয়ে একটি দলকে পাঠানো হয়। পাকিস্তানি সেনারা সম্পূর্ণ সজাগ ছিল এবং আমাদের ২ জন কমান্ডো ধরা পড়ে যায়।

মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন যোদ্ধা দেওতলীতে এ্যামবুশ পাতে। পাকবাহিনীর একটি দল কুমারসাইল মসজিদের কাছে এলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে পাকবাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।

মুক্তি বাহিনীর একটি কোম্পানি বিকালে বল্লভপুরে পাক অবস্থানের উপর হামলা করে। ক্যাপ্টেন মাহফুজের আরেকটি কোম্পানি চম্পকনগরে পাক অবস্থানের উপর হামলা করে । পাকিস্তানীরা তাদের জনবল বৃদ্ধি করে হামলা প্রতিহত করে। ১ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয় ২ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতের ভিতরে এক ভারতীয় সৈন্য আহত হয়। এই দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় একজন পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন নিহত হয় ১৩ বালুচ এর এই ক্যাপ্টেন কোথায় কোন যুদ্ধে মারা যান তাহা জানা যায় নাই।

এদিকে,  প্রাদেশিক সভাপতি শামশুল হুদাকে বহিস্কার ইস্যুতে কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে কনভেনশন মুসলিম লীগ। শামশুল হুদা বলেন, ক্ষমতার লোভে ফজলুল কাদের বেসামাল,  তার বহিস্কার অবৈধ এবং অগণতান্ত্রিক। তিনি (ফজলুল কাদের) বিবৃতি পাঠিয়ে তাকে বহিস্কার করেছে যা তার ক্ষমতা বহির্ভূত । বহিস্কারের ক্ষমতা কার্যকরী সংসদের উপর।

তিনি বলেন, ৭০ এর নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর কাদের পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছিলো। কেন্দ্রীয় কার্যকরী সংসদ তা গ্রহনও করে নাই এবং পত্র প্রত্যাহারের অনুরোধও করে নাই। পরবর্তী সভায় তার সেই দাখিলকৃত পদত্যাগ পত্র নিয়া সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ৩০ সদস্য বিশিষ্ট কার্যকরী সংসদের ৯ জন সদস্য পত্রিকায় বিবৃতি দিয়া হুদার পক্ষ নেয় অপর দিকে দলের ৫ নেতা কাদেরের পক্ষ নিয়ে পত্রিকায় বিবৃতি পাঠায়।

অন্যদিকে, মাহমুদ আলী জাতিসংঘ সদর দপ্তরে নাইজার, জর্ডান, ইন্দোনেশিয়া প্রতিনিধিদলের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের গোলযোগের বিশদ বর্ণনা দেন।  তার দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত যাতে হস্তক্ষেপ না করে তা ভারতকে বুঝানোর জন্য তাদের অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, সোভিয়েত ভারত সামরিক চুক্তির পর ভারত নিরপেক্ষ দেশের মর্যাদা হারিয়েছে ফলে জোট নিরপেক্ষভুক্ত দে গুলির উচিত ভারত হতে দূরে থাকা। আগে ত্থেকেই জর্ডান ইন্দোনেশিয়া পাকিস্তানের সমর্থক। নাইজার নিরপেক্ষ ছিল।

এদিকে, ভারতের মেঘালয়ে শরণার্থী শিবির গুলিতে কলেরায় প্রায় ৭৫০০ শরণার্থী মারা যায়। এ নিয়ে শরণার্থী শিবিরগুলিতে ২য় বারের মত কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। কেবল জুন মাসেই কলেরায় মারা গেছে ৩০ হাজার শরণার্থী। তখন মেঘালয় কলেরা মুক্ত ছিল। জুন মাসে কলেরায় কেবল কৃষ্ণনগর ফিল্ড হাসপাতালেই ৫০০০ নারী ও শিশু শরণার্থীর মৃত্যু হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here