ঘুরে আসুন সপ্ত প্যাগোডা

0
472

রাজিবুল হাসান: চেন্নাই থেকে ৫৮ কিমি দূরে সপ্ত প্যাগোডার শহর মহাবলিপুরম। গোটা শহর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে পল্লব রাজাদের মন্দিরগুচ্ছ। পাহাড় কেটে নির্মিত ১০ টি গুহা মন্দির, ৯ টি মনোলিথিক একশিলা রথ মহাবলীপুরমের প্রধান আকর্ষণ হলেও এখানকার সমুদ্র সৈকতের আকর্ষণ অস্বীকার করার নয়।

ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়াল্ড হেরিটেজ সাইট মহাবলীপুরম। মহাবলী পৌঁছে পায়ে পায়ে বা গাড়ি ভাড়া করে একে একে দেখে নিতে পারেন পল্লবরাজ দ্বিতীয় নরসিংহ বর্মন নির্মিত শোর টেম্পল, বৌদ্ধবিহারের আদলে নির্মিত পঞ্চপান্ডব রথ, বিশ্বের বৃহত্তমব্যাস রিলিফ অর্জুনের তপস্যা, টাইগার কেভ, লাইট হাউস, শ্রীকৃষ্ণ বাটার বল প্রভৃতি।

শোর টেম্পলের কাছেই মহাবলীপুরমের মনোরম সাগরবেলা। নীল সমুদ্রের ফেনিল তরঙ্গ আছড়ে পড়ছে শোর টেম্পলের গায়ে। দূরে দেখতে পাবেন জেলেদের রঙিন পালতোলা নৌকা। দিনে দিনে দেখে নেওয়া গেলেও নির্জন নিরালা মহাবলীতে একটা দিন থাকলে আরও মধুর হয়ে ওঠে ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। মহাবলীপুরম বেড়িয়ে চলে যাওয়া যায় পন্ডিচেরীর দিকে।

বঙ্গোপসাগরের নীল জলের অবিরাম আসা-যাওয়া। কান পাতলেই শোনা যায় ঝাউবনে বাতাসের শব্দ। বিস্তীর্ণ বালুকাবেলায় জেগে থাকা অনবদ্য কিছু প্রস্তর ভাস্কর্য। অনন্ত সলিল আর গৌরবময় অতীতের এক নিবিড় সম্পর্ক। আছড়ে পড়া ঢেউয়ের বুকে কান পাতলে শোনা যায় প্রবল পরাক্রমশালী রাজারাজড়াদের কীর্তিকাহিনী। অজস্র নাম না জানা শিল্পীর কঠিন অধ্যবসায়, আত্মত্যাগের গল্পগাথা।

মহাবলীপুরমের আরেক নাম মামল্লাপুরম। ভগবান বিষ্ণু বামনাবতার রূপে মহাবলী অসুরকে বধ করেন। সেই অসুরের নামেই স্থানটির নাম। আবার অনেকের মতে, সপ্তম শতকের পরাক্রমশালী সম্রাট নরসিংহ মহামল্লের নামের অপভ্রংশেই এসেছে মামল্লাপুরম। তবে নামে কী আসে যায়? মহাবলীপুরম হোক বা মামল্লাপুরম – অঞ্চলটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব তাতে বিন্দুমাত্র কমে যায় না।

বঙ্গোপসাগরের বালুকাবেলায় খ্রিস্ট্রীয় সপ্তম শতকে আস্ত পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছিল এখানকার মন্দিরগুলো। প্রকৃতির রোষানলে পড়ে ইতিমধ্যেই লুপ্ত হয়েছে এখানকার বেশ কয়েকটি মন্দির। ছোট ছোট পাথরের টিলা কেটে তৈরি হয়েছে পঞ্চরথ। এখানে নয়টি রথ থাকলেও পাশাপাশি রয়েছে পাঁচটি। এরা পঞ্চপাণ্ডব নামেই পরিচিত। আছে দ্রৌপদীর নামেও রথ।

অনেকটা বাংলার চালারীতিতে তৈরি ছোট্ট রথের ভেতরে রয়েছেন চতুর্ভুজা দেবী দুর্গা। এটিই দ্রৌপদীর রথ। এর সামনে একটু বড়, ধাপে ধাপে উপরে ওঠা মন্দিরটি অর্জুনের। খুব সুন্দর এই মন্দিরের গায়ের প্যানেলগুলোতে রয়েছে দ্বারপাল, শিব, দেবরাজ ইন্দ্র ও বিষ্ণুর মূর্তি।

মহাবলী ভীমের রথটি বেশ বড় এবং আয়তকার দোচালা ঘরের মতো। এতে অন্যান্য মন্দিরের মতোই রয়েছে নকল দালান, চাতাল ইত্যাদি। মন্দিরের গায়েও রয়েছে অজস্র দেবদেবীর মূর্তির সমাহার।

এই পঞ্চরথের মধ্যে সবচেয়ে বড়টি স্বয়ং ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের। আকৃতিতে খানিকটা পিরামিডের মতো কিছুটা অর্জুনের রথের মতো দেখতে হলে তুলনায় অনেক বৃহদাকারের। বর্গাকার ভূমি থেকে ধাপে ধাপে উঠেছে উপরের দিকে। দেয়ালের প্যানেলে দেখা যায় চতুর্ভুজ মহাদেব। আছেন ব্রহ্মা, কার্তিক এবং হরিহরও। পল্লবরাজ নরসিংহবর্মনের একটি মূর্তিও রয়েছে এখানে।

প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের অসামান্য এক নিদর্শনস্বরূপ এখানে দেখা যাবে একটি অর্ধনারীশ্বর মূর্তিও, যেন একই অঙ্গে হর-পাবর্তী, সৃষ্টি ও ধ্বংসের এক অপরূপ মেলবন্ধন। এখানকার দেয়ালে খোদিত আছেন শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী বিষ্ণু; আছে পুরাণের নানা উপকথা – কৃষ্ণের কালীয়দমন। পাশেই নকুল-সহদেবের রথ। আকৃতিতে ছোট হলেও মন্দির গাত্রের অলংকরণের বিষয়ে মোটেও পিছিয়ে নেই।

রথের সামনে বৃহদাকারের এক হস্তিমূর্তির উপস্থিতি গোটা পরিবেশে এনে দিয়ে এক গাম্ভীর্যময় অনুষঙ্গ। পঞ্চরথ ছাড়াও এখানে বহু শিল্পকীর্তি রয়েছে। সাগরবেলার ভুবনবিখ্যাত মন্দিরগুলো তৈরি হয় সপ্তম শতাব্দীতে পল্লবরাজ নরসিংহবর্মনের আমলে। বেশ কয়েকটি মন্দির চলে গিয়েছে সাগরের গ্রাসে। সাগর সৈকতের এই মন্দিরগুলো সৈকত মন্দির নামেই পরিচিত।

দ্রাবিড়ীয় রীতিতে তৈরি মন্দির দুটি পাঁচতলা, পিরামিডের মতো ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে। দীর্ঘকাল বালির নিচে চাপা পড়ে থাকার পর ১৯৪৫ সালে বালি সরিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে। একটি মন্দিরে রয়েছে শিব, অন্যটিতে অনন্তনাগের শয্যায় শায়িত ভগবান বিষ্ণু। এই অবাক করা মূর্তিটি দেখলে মনে হয়, সময় যেন থমকে গিয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় ভাস্কর্যশিল্পের খনি এই মহাবলীপুরমে রয়েছে বহু কিছু, যার অন্যতম হলো বারোটি গুহামন্দির বা মণ্ডপ।

এখানকার বিখ্যাততম ভাস্কর্য অর্জুনের তপস্যা। পাহাড়ের গায়ে ব্যাস-রিলিফের কাজ। অজস্র মূর্তির মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে পাশুপাত অস্ত্রের জন্য তপস্যারত অর্জুনের কাহিনী। ৯০ ফুট লম্বা এই ভাস্কর্যটিতে রয়েছে অজস্র মূর্তি। দেখানো হয়েছে গঙ্গার মর্ত্যে আগমন। মহিষমর্দিনী মণ্ডপে আছে দেবী দুর্গার সাথে মহিষাসুরের যুদ্ধ।

বরাহ মণ্ডপে দেখা যাবে বরাহ ও বামন অবতারের রূপধারী বিষ্ণুকে। কৃষ্ণ মণ্ডপে দেখানো হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের জীবনের সুপরিচিত ঘটনাবলি। এখানকার গোবর্ধন ধারণের মূর্তিটি ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য হিসেবে বিখ্যাত। ইতিহাস আর প্রকৃতির মধ্যে ঋদ্ধ মহাবলীপুরম নিঃসন্দেহে অতুলনীয়।

কিভাবে যাবেন
চেন্নাই সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড থেকে মহাবলীপুরমের বাস ছাড়ছে। সময় নেয় ২ ঘণ্টার মত। ১৮৮এ, ১৮৮বি, ১৮৮সি, ১৮৮ডি রুটের বাস সার্ভিস বেশ ভালো। তবে এ পথে নিজস্ব গাড়ি বা অটো ভাড়া করে আসতে পারেন।

যেখানে যাবেন চেষ্টা করবেন আপনার কারনে যেন পরিবেশ নোংরা না হয়।

কোথায় থাকবেন
মহাবলীপুরমে থাকার সেরা জায়গা তামিলনাড়ু পর্যটনের হোটেল তামিলনাড়ু, ভাড়া- ২,২০০-৩,৬০০ টাকা, যোগাযোগ- ০৪৪-২৭৪৪২৩৬১/৬২। এছাড়া হোটেল মামল্ল হেরিটেজ, ভাড়া- ২,৬০০-২,৮০০ টাকা, যোগাযোগ- ০৪৪-২৭৪৪২০৬০। শ্রী মুরুগান গেস্ট হাউস, ভাড়া- ৮০০-১,৬০০ টাকা, যোগাযোগ- ০৪৪-২৭৪৪২৬৬২, রামকৃষ্ণ লজ, ভাড়া- ১,৫৫০-১,৮৫০ টাকা, যোগাযোগ- ০৪৪-২৭৪৪২৩৩১। হোটেল সী ব্রিজ, ভাড়া- ২,২০০-৩,২০০ টাকা, যোগাযোগ- ০৪৪-২৭৪৪৩০৬৫। হোটেল সূর্য রিসর্ট, ভাড়া- ২,২০০-২,৭০০ টাকা, যোগাযোগ- ০৪৪-২৭৪৪২২৯২। হোটেল শিবা, ভাড়া- ৮০০-১,৬০০ টাকা, যোগাযোগ- ০৪৪-২৭৪৪৩৫৩৪।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here