সালাহ উদ্দিন: ১৯৭১ এর ১৮ সেপ্টেম্বরে সিলেটে মুক্তিবাহিনীর ৬০ জনের সুতারকান্দি পাকঘাঁটি আক্রমণ করে। পাকসেনারা পাল্টা গুলি শুরু করলে উভয়পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। উভয় পক্ষ ৩ ইঞ্চি মর্টার ব্যাবহার করে। এই সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ২ জন সৈন্য নিহত হয়। সিলেটের সীমান্তে হেলিকপ্টারের আনাগোনা দেখা যায়।
পাকসেনা্রা মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে ২৫ রাউনড ১০৫ এমএম শেল নিক্ষেপ করে। শেল গুলি ক্যাম্পের কাছাকাছি পরেছিল। শাবাজপুরের ঝিঙ্গালায় ৬০ জনের মুক্তিবাহিনীর একটি দল ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে পাকবাহিনীর উপর হামলা করে ৭ জন শত্রু নিহত হয়। জৈন্তাপুরে পাকবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর ওয়ারলেস সেট হারাতে হয়।
খুলনার ডুমুরিয়ায় সন্ধায় একদল রাজাকার সামরিক ক্যাম্প থেকে ফেরার পর রঘুনাথপুর বাজারের কাছে নক্সালিদের হামলার মুখে পড়ে। রাজাকাররাও পাল্টা আক্রমন করে। একজন নক্সাল, ২ জন রাজাকার নিহত হয়। কয়েক রাজাকার আহত হয়।
নিলফামারির ডিমলায় ৩টি পৃথক মাইন বিস্ফোরণে ১ জন গ্রামবাসী নিহত হয়। ২ টি গরুগারি ধ্বংস হয়। পাক বাহিনী রাজশাহী এর রামনগর ত্রিমোহিনীতে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশ সরকারের প্রচারপত্র আটক করে। এই সকল প্রচার পত্রে মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের কথা ও এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম শ্লোগান লিখা ছিল।
৭নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনী ইপিআর কমান্ডার সালেক, বেঙ্গল রেজিমেন্টের মান্নান, ঢাকা পুলিশের হাবিলদার রজব আলী এবং ছাত্র রঞ্জিত কুমার মহন্ত, প্রদীপ কুমার কর প্রমুখের নেতৃত্বে হিলির কাছে পাকসেনাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই সংঘর্ষে কতক পাকসৈন্য হতাহত হয়। মাইন বিস্ফোরণে একটি বেডফরড ট্রাক ধংশ হয়।
শ্রীনগর এলাকায় ১৯ রাজপুতানা রাইফেলস এর কর্নেল শর্মার মেজর রফিকের প্রথম মিটিং হয়। বর্ডারের কাছে ভারতীয় সৈন্যদের সহায়তায় পাকসেনাদের ছোট কয়েকটি অবস্থান হামলা করে মুক্ত করা্র সিদ্ধান্ত হয়। পাকসেনারা বর্ডার ক্রস করে যাতে পুনরায় আক্রমণ না চালাতে পারে সে ব্যাপারে ভারতীয় বাহিনীর সমর্থন পাওয়া কাজে লাগছে। রাজপুতানা রাইফেলস একটি গোলন্দাজ ব্যাটেলিয়ন।
এদিকে, বাংলাদেশ প্রশ্নে আলোচনার জন্য বিশ্বের ২৪টি দেশ থেকে ১৫০ জন প্রতিনিধি দিল্লী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনে বাংলাদেশ সমস্যার সন্তোষজনক সমাধানের লক্ষ্যে বেশ কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সকল দেশ বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রাম সমর্থন করেন। বাংলাদেশ সরকারের কর্মকান্ড ও ভারতে শরণার্থীদের আশ্রয়দানকে তারা অভিনন্দন জানান।
১৮ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক কনফারেন্স পাকিস্তানের সামরিক ট্রাইব্যুনালে শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারকে নিন্দা জানায় এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের নির্বাচিত অন্য প্রতিনিধিদের দ্রুত ও নিঃশর্ত মুক্তির জন্য অনুরোধ করে।সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে সহযোগিতা প্রদানেরও আশ্বাস দেয়া হয়।
সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক এনডিএফ নেতা দৈনিক অবজারভারের মালিক হামিদুল হক চৌধুরী প্রদেশে বেসামরিক মন্ত্রীসভা গঠনকে অভিনন্দন জানান। বাকি ৪ প্রদেশেও অনুরূপ ব্যাবস্থা গ্রহনের আহবান জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন বেসামরিক সরকার জনগনের মধ্যের দূরত্ব কমিয়ে আনবেন এবং ধ্বংস প্রাপ্ত অর্থনীতি সচল করার চেষ্টা করবেন।
অন্যদিকে, পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমীর গোলাম আযম নতুন প্রাদেশিক মন্ত্রীসভাকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, এই সংকটকালে মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করে মন্ত্রীসভার সদস্যরা শুধু যে বিপদের ঝুঁকি নিয়েছেন তাই নয়, তারা পাকিস্তানের শত্রুদের (মুক্তিবাহিনী) নির্মুল করার কাজে নিয়োজিত পাকিস্তানের বীর সেনাবাহিনীর প্রতি হতাশ ও আকাঙ্খিত মানুষের মধ্যে আস্থার ভাব ফিরিয়ে আনারও গুরু দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
এদিন, যশোরে সামরিক আদালতে আটক বিদেশী ত্রান দল অপারেশন ওমেগা সদস্যদের ভুয়া আখ্যায়িত করে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে সাজা দেয়া হয়েছে। আগামি ফ্লাইট এ পাকিস্তান ত্যাগ করা সময়কাল পর্যন্ত তারা সাজা ভোগ করবেন। দলটিতে ৪ জন সদস্য রয়েছেন। এদের মধ্যে পল কনেট এবং এল্লেন কনেট স্বামী স্ত্রী। অপর দুই জন হলেন গরডন স্লাভেন ও জয়েস কেন্নিওেল।
জাতীয় লীগ প্রধান পশ্চিম পাকিস্তানের করাচীর আখবারে জাহান পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আওয়ামী লীগ ভারতের সহযোগিতায় পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। তিনি আরও বলেন, আল্লাহর বিধি বিধান অমান্য করার কারনে পাকিস্তানের প্রতি আল্লাহর গজব পড়েছে। আওয়ামী লীগের কার্যকলাপ ক্ষমার যোগ্য নয়। আমরা ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের ভেতর থেকে স্বয়ং সম্পূর্ণ পূর্ব পাকিস্তানের স্লোগান দিয়েছি এর অর্থ এই নয় যে আমরা বিচ্ছিন্ন হতে চেয়েছি। মতানৈক্য ও বিদ্রোহের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। তিনি সম্পূর্ণ মন্ত্রী মর্যাদায় পুলিশ প্রটেকশন পেতেন।
এদিন পাকিস্তান সরকার ক্ষমার আওতায় প্রথম ধাপে কিছু বন্দী মুক্তি দিয়েছে। এই সকল আসামী গত ১ মার্চ থেকে ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আটক হইয়াছিল। মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে সামরিক আধা সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্য আছে। এদের চাকুরিতে ফিরাইয়া নেয়া হবে এবং পূর্বের সকল বকেয়া প্রাপ্ত হইবেন।
১৯৭১ এর ১৯ সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ মহাসচিব উ’থান্ট ভারত উপমহাদেশের অবস্থা নিয়ে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক মীমাংসা ব্যতিত পূর্ব পাকিস্তানের মৌলিক সমস্যা সমাধান হবে না।
অপরদিকে জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত আগাশাহি ভারতে অবস্থান রত পাকিস্তানী শরণার্থীর প্রকৃত সংখ্যা নিরুপনের জন্য উথানট এর কাছে যে আবেদন জানানো হয়েছিলো তার বিষয়ে গণমাধ্যমে পাকিস্তান সরকার জানায়।
এদিন দলের প্রাদেশিক সভাপতি খাজা খয়ের উদ্দিনের বাসভবনে দলের কেন্দ্রীয় পরিষদের এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মন্ত্রীপরিষদ এ তার দলের দুই জনের অন্তর্ভুক্তি নিয়া আলাপ আলোচনা করা হয়। বর্ণিত দুই মন্ত্রী নিয়োগে কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক কোন সরকার তার দলের সহিত আলোচনা না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। তা সত্ত্বেও বৃহত্তর স্বার্থে দল তা মেনে নিয়েছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আসন্ন অধিবেশনে যোগদানের জন্য পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নিউইয়র্ক যাত্রার প্রাক্কালে দলনেতা পিডিপি-র মাহমুদ আলী করাচীতে বলেন, সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যা চালিয়েছে বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কেননা প্রদেশের সেনাবাহিনীর তৎপরতা এমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি করেনি, যার জন্য ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহৃত হতে পারে।
এদিকে, ২নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল মালোচিন বাজারে অবস্থানরত পাকপুলিশের একটি দলকে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে ১৯ জন পাক পুলিশ নিহত ও ৩ জন আহত হয়। ৫০০ মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নদী পার হয়ে মুনশিগঞ্জের টঙ্গীবাড়িতে দিঘিরপাড় বাজারে ২ জন স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতাসহ ৩ জনকে হত্যা করে।
৮নং সেক্টরের গোজাডাঙ্গা সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের মোহাম্মদপুর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে পাকবাহিনীর একজন মেজরসহ (প্রকৃত পক্ষে সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হবে) ৬ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা কোন ক্ষতি ছাড়াই নিরাপদে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে আসে।
অন্যদিকে, শবে মিরাজ উপলক্ষে জামাতে ইসলামী ইসলামী ছাত্র সংঘ ইসলামী সংগ্রাম পরিশদ যৌথভাবে এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। উপস্থিত ছিলেন গোলাম আজম, মওলানা মাসুম, মতিউর রহমান নিজামি, আলি আহসান মুজাহিদ, সরদার আব্দুস সালাম, এডভোকেট নইম চৌধুরী। সভায় বিভিন্ন ধর্মীয় বয়ান শোনানো হয়।
পরে জামাতে ইসলামীর শহর সভাপতির শুন্য পদে নির্বাচন হয়। শহর সাধারন সম্পাদক গোলাম সারওয়ার সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। আগের সভাপতি খুররম শাহ মুরাদ পদত্যাগ করলে পদটি শুন্য হয়।
এদিন, জমিওতে ওলামা ইসলাম এর কেন্দ্রীয় সাধারন সম্পাদক মৌলানা গাউস হাজারভি পেশোয়ারে বলেছেন পূর্ব পাকিস্তানে জামাতে ইসলামী প্রতিপক্ষের উপর প্রতিশোধ নিতেছে। তিনি আর বলেন জামাতিরা তাদের বিশ্বাসঘাতক হিসাবে চিহ্নিত করেছে। এধরনের বেক্তিদের উপর নজর রাখার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহবান জানান।
পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেন ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ৭৮ টি শূন্য আসনে এবং প্রাদেশিক পরিষদের ১০৫ টি শূন্য আসনে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।