সাংবাদিকতা নষ্টের মূলে কারা

0
66
‘দেশে সাংবাদিকতা নেই, নষ্ট হয়ে গেছে’-কয়েকদিন ধরে নেটিজেনরা এমন নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছেন। ফেসবুকে ঢুকলেই সাংবাদিকতা নিয়ে কড়া সমালোচনার পোস্ট দেখছি। প্রশ্ন হচ্ছে, সাংবাদিকতা নষ্টের মূলে কারা দায়ী, কেন দায়ী? আমার ব্যক্তিগত ধারণা, দলীয় বয়ানে অন্ধ আসক্তি আর দেশ, রাষ্ট্র, সরকার, ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে পার্থক্য করতে না পারার অক্ষমতাই সাংবাদিকতার মৌলিক কাঠামো নষ্ট করছে। কীভাবে ঘটছে-
প্রেসক্লাব সংস্কৃতি
পরিবারসহ সাংবাদিকদের বিনোদনভিত্তিক ক্লাব সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠান প্রেসক্লাবগুলো মৌলিক চরিত্র হারিয়ে রাজনৈতিক দলের বয়ানের পক্ষে সম্মতি উৎপাদনের ফেরিওয়ালায় পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের বয়ানের পক্ষে বৃদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে দেশের প্রতিটি প্রেসক্লাব। এসব ক্লাবের সদস্য হওয়ার জন্য ভালো সাংবাদিকতা বা ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা নয়, বরং দলের দাসত্বই বড় যোগ্যতা। মূলত, প্রেসক্লাব সংস্কৃতি চূড়ান্তভাবে নির্মোহ, সাহসী সাংবাদিকতার পরিপন্থি।
ট্রেড ইউনিয়ন
সংবাদকর্মীদের অধিকার সুরক্ষায় দেশে বিদ্যমান আইন-বিধিগুলোই যথেষ্ট। তারপরও সংবাদশ্রমিকদের পক্ষে মালিকদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে ট্রেড ইউনিয়ন ভালো ভূমিকা রাখতে পারতো। তবে সেই মৌলিক চরিত্র হারিয়ে ইউনিয়নগুলো ক্ষমতাসীন দলের ‘মিডিয়া সন্ত্রাসী’ শাখায় পরিণত হয়েছে। ফলে কল্যাণ ফান্ডের টাকার অগ্রাধিকার, ফ্রি হজ, প্রেস মিনিস্টার পদের জন্য মেরুদণ্ড খুইয়ে ফেললে তাদের হাতে সাংবাদিকতা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
বিট সংগঠন
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মূল কারণ আন্দোলনের চালিকাশক্তি বা একক নেতৃত্বকে ট্রেস করতে না পারা। প্রভাবশালীরা তাদের দুর্নীতি বা অনিয়মের রিপোর্ট আটকাতে প্রতিপক্ষ মিডিয়া বা রিপোর্টারকে বাগে আনেন। ফলে তারা জাল থেকে ফঁসকে যেতে পারেন। সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে বেপরোয়া দুর্নীতিবাজদের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করে দেয় বিট সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো। এরা সংগঠনের অফিস ভাড়া, পরিচালনা ব্যয়, বিদেশ ভ্রমণের সুবিধা নিয়ে মাফিয়া সিন্ডিকেট তৈরি করেন। ফলে এরা নিয়ন্ত্রণযোগ্য হয়ে ওঠেন। যাতে সাহসী সাংবাদিকতার অপমৃত্যু ঘটে।
আঞ্চলভিত্তিক সংগঠন
জেলা বা বিভাগভিত্তিক সাংবাদিক সংগঠনগুলো মূলত প্রেসক্লাব বা ইউনিয়নের নেতাদের ভোট ব্যাংক হিসেবেই তৈরি করা। মুখচেনা কিছু নেতা এসব সংগঠনে নেতৃত্ব দেন। ফলে প্রেসক্লাব বা ইউনিয়নের নির্বাচনে নিজ অঞ্চলের ভোটের নিশ্চয়তা তৈরি হয়। চাঞ্চল্যকর বা অনুসন্ধানি প্রতিবেদনের জন্য কোনো রিপোর্টার অঞ্চলভিত্তিক সংগঠন থেকে কিছু না পেলেও প্রেসক্লাব, ইউনিয়ন বা রিপোর্টারদের সংগঠনে নির্বাচিত নেতারা ঢাউস আকৃতির ফুলের মালা পান। ফলে অঞ্চলভিত্তিক সংগঠন ভালো সাংবাদিকতা নিয়ে আলোচনা বা উৎসাহ তৈরি করে না।
একাডেমিক সিন্ডিকেট
ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় উচ্চ ডিগ্রিধারীরা গণমাধ্যমে এসে একাডেমিক সিন্ডিকেট তৈরি করেন। যারা গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারণ আর নিয়োগপ্রক্রিয়া কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে এলিট শ্রেণী তৈরি করেন। দলীয় বয়ানের পক্ষে এরা শৈল্পিকভাবে সম্মতি উৎপাদনের কাজটি করেন। যারা এলিট বা তারকা সাংবাদিক হিসেবে সরকারপ্রধান পর্যন্ত পৌঁছে যান। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে গণমাধ্যমকে সরকারিমাধ্যম বানিয়ে ফেলেন। সাংবাদিকতায় তারাই ভালো আর সাহসী তারুণ্যকে ঠেকিয়ে রাখেন।
টকশো সিন্ডিকেট
কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বয়ানের পক্ষে রোলপ্লে করতেই প্রেজেন্টার বা সঞ্চালকদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করেন মিডিয়ার নীতিনির্ধারকরা। রাজনৈতিক মিশন আর ভিশন বাস্তবায়নে টকশোতে ঘুরে ফিরে নির্দিষ্ট কিছু মুখকেই সামনে আনা হয়। এলিট বা তারকা সাংবাদিকরা টকশোতে একাডেমিক সিন্ডিকেটকে দারুণভাবে কাজে লাগান। ফলে টকশোগুলো দেশ বা রাষ্ট্র নয়, দল বা গোষ্ঠীকেই প্রমোট করার লক্ষ্যে ফর্মুলেটেড। যেখানে শুদ্ধ রাজনৈতিক চর্চার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
সম্পাদকীয় নীতি
গণমাধ্যমের মালিকপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব বুঝেই তৈরি হয় সম্পাদকীয় নীতি। বেতনভোগী সম্পাদকেরা মালিকপক্ষের মনরক্ষা বা নিজেদের চাকরি স্থায়ী করতেই এমন নীতি প্রণয়ন করেন।যারা রাজনৈতিক কিছু শব্দের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন।যা কোনো দলীয় বয়ানকেই প্রতিষ্ঠিত করতে ভূমিকা পালন করে। সম্পাদকীয় নীতি মূলত কোন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করা হবে, সে বিষয়ের সিদ্ধান্ত। যার ওপর নির্ভর করে বুদ্ধিজীবী বা কলাম লেখকদের তালিকা হয়। এখানে যে সিন্ডিকেট কাজ করে তাতে দেশপ্রেমের চেয়ে দলপ্রেমী সাংবাদিকতা অগ্রাধিকার পায়।
নোট
দলপ্রেমকে দেশপ্রেম হিসেবে দেখার ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা সহজে বেরুতে পারছি না। সেই সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের কারণে মন-মননে হীনমন্যতার যে বীজ বপন হয়েছিল তা থেকেই আমরা ব্যক্তি বা পরিবারপূজায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছি। এমন প্রবণতা জনমানস থেকে দূর করতে সবার আগে গণমাধ্যম তথা সাংবাদিকদের ভূমিকা পালন করতে হবে। অথচ সেই সাংবাদিকরাই যদি দল, ব্যক্তি বা পরিবারকে দেশ মনে করেন তাহলে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণমাধ্যম কখনই মর্যাদা পাবে না।

লেখক: নিয়ন মতিউল, সিনিয়র সাংবাদিক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here