বাংলাদেশ আজ এক গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত। দ্রব্যমূল্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়া, বৈদেশিক ঋণের চাপ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং একটি গভীর সামাজিক অনাস্থা দেশটিকে ঘিরে ফেলেছে। অনেকের কণ্ঠেই আপনার মতোই প্রশ্ন জাগে: “এই অবস্থার পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব?” আপনি যা বলেছেন, তার সারমর্ম হলো—আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সমাধান সময়সাপেক্ষ; তাই দেশের মাটির তাগিদে দেশের মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু ‘গণঅভ্যুত্থান’ নামের এই জটিল ও গুরুভার প্রক্রিয়াটি কীভাবে সংঘটিত হবে, তা নিয়েই এই আলোচনা।
এটা সঠিকভাবে চিহ্নিত হয়েছে যে, একটি সফল গণঅভ্যুত্থান কেবলমাত্র রাস্তায় নামলেই হয় না। এর জন্য প্রয়োজন সুস্পষ্ট লক্ষ্য, সংগঠন, এবং সম্পদ। ইতিহাস বলছে, স্বতঃস্ফূর্ততার পাশাপাশি কোনো না কোনো রূপে সংগঠন ও অর্থনৈতিক ভিত্তির প্রয়োজন হয়।
১. আর্থিক সংস্থান (ফান্ড): বিনিয়োগ না দেশপ্রেমের?
এখানে যে মূল সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়েছে , তা অত্যন্ত বাস্তব। টাকা ছাড়া বড় কোনো আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। প্রচার-প্রচারণা, যোগাযোগব্যবস্থা, আইনি সহায়তা এবং কর্মীদের ন্যূনতম সমর্থন দেওয়ার জন্য অর্থের প্রয়োজন। তাহলে এই ফান্ড কিভাবে জোগাড় হবে?
প্রথম স্তর: অভ্যন্তরীণ উৎস
ক্ষুদ্র অনুদানে: বাংলাদেশে কোটি কোটি মানুষ আছেন, যারা দেশের জন্য কিছু করতে চান। একটি স্বচ্ছ, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুদান সংগ্রহ করা যেতে পারে। ‘এক টাকায় দেশ গড়ি’—এই ধরনের একটি প্রচারণা বিশাল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করতে পারে, যদি জনগণের বিশ্বাস অর্জন করা যায়।
মধ্যবিত্ত ও ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ততা: যেসব ব্যবসায়ীরা আছেন , যারা সুসময়ে লাভবান হয়েছেন, তাদের একটি অংশই চান না দেশটি অস্থিতিশীল হোক। তাদের মধ্যে দেশপ্রেমিক ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করতে হবে। এটি একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর কাজ, কারণ তাদেরকে বর্তমান ব্যবস্থার রোষাণলেরও মুখোমুখি হতে হবে।
প্রবাসী বাংলাদেশীদের ভূমিকা: বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ প্রবাসী বাংলাদেশী দেশের জন্য একটি শক্তিশালী স্তম্ভ। তাদের কাছ থেকে আর্থিক ও নৈতিক সমর্থন সংগ্রহ করা যেতে পারে। তাদের অনেকেই আন্তর্জাতিক আইন, কূটনীতি ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ, যাদের পরামর্শ অমূল্য।
দ্বিতীয় স্তর: নৈতিক ও স্বচ্ছতা চ্যালেঞ্জ
স্বচ্ছতা: সংগ্রহকৃত টাকার হদিস একটি পাবলিক ডিজিটাল লেজারে রাখতে হবে। জনগণ যেন দেখতে পান তার দেওয়া টাকা কোথায় খরচ হচ্ছে। বিশ্বাসই হলো সবচেয়ে বড় মূলধন।
নৈতিক অবস্থান: বিদেশি শক্তির কাছ থেকে অর্থ নেওয়া হবে কিনা, তা একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এর ফলে আন্দোলনের লক্ষ্য ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার ঝুঁকি থাকে। তাই, সম্পূর্ণভাবে অভ্যন্তরীণ উৎসের উপর নির্ভর করাই শ্রেয়।
২. মানবসম্পদ ও সংগঠন: বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজনীয়তা
এটা সঠিক যে শুধু রাস্তার লোকবল যথেষ্ট নয়। একটি দেশ চালানোর বিকল্প পরিকল্পনা নিয়েই আন্দোলন করতে হয়।
শ্যাডো টাস্কফোর্স গঠন: অবসরপ্রাপ্ত সৎ ও দক্ষ আমলা, সেনা কর্মকর্তা, অর্থনীতিবিদ, আইনবিদ, আইটি বিশেষজ্ঞ এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের নিয়ে বিভিন্ন টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। তাদের কাজ হবে:
অর্থনীতি টিম: বর্তমান সংকট কাটিয়ে ওঠার এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি টেকসই অর্থনৈতিক মডেল প্রস্তুত করা।
আইন ও শাসন টিম: সংবিধান ও আইন থেকে পরিবর্তনের রূপরেখা প্রণয়ন।
যোগাযোগ ও মিডিয়া টিম: দেশি-বিদেশি মিডিয়ার সাথে কার্যকরভাবে যোগাযোগ এবং জনমত গঠন।
তরুণ ও ছাত্র নেটওয়ার্ক: দেশের তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাই হল বড় পরিবর্তনের চালিকাশক্তি। তাদের সংগঠিত করা অপরিহার্য।
৩. গণঅভ্যুত্থানের কৌশল: শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও টেকসই
স্পষ্ট লক্ষ্য: শুধু “সরকার পতন” নয়, “এরপর কী?”—এই প্রশ্নের উত্তর জনগণের কাছে স্পষ্ট করতে হবে। একটি অন্তর্বর্তীকালীন শাসনব্যবস্থা, নিরপেক্ষ নির্বাচন ইত্যাদির একটি রোডম্যাপ থাকতে হবে।
অহিংস আন্দোলন: ইতিহাস প্রমাণ করেছে, অহিংস আন্দোলনই বেশি টেকসই ও আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়।
সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল প্রতিরোধ: শিল্প, সাহিত্য, নাটক, গান, সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে মানুষের মন ও মনন জয় করা যায়, যা রাস্তার আন্দোলনের চেয়েও অনেকগুণ শক্তিশালী।
আমরা যা চাই, তা হলো একটি সিস্টেমের পরিবর্তন। এটি কোনো সহজ কাজ নয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি, পরিশ্রমী ও ত্যাগের পথ। যারা বিদেশে রয়েছেন, তাদের মধ্যে অনেকে হয়তো ভয় বা হতাশার কারণেই আছেন। তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের জ্বালানোও এই আন্দোলনের।
তবে, একটি বিষয় সর্বদা স্মরণে রাখতে হবে: যে আগুনে একট ব্যবস্থা পুড়ে যায়, সেই একই আগুনে ভবিষ্যতও পুড়ে যেতে পারে। রাগ ও হতাশাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে, কিন্তু সেই শক্তি যেন ধ্বংসাত্মক না হয়ে সৃষ্টিশীল হয়। বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করতে জানে। ১৯৭১ সালে একটি অসম যুদ্ধে জয়লাভের অসাধারণ দৃষ্টান্ত রয়েছে আমাদের রক্তে।
আপনার এই চিন্তা, এই ব্যথা এবং এই পরিকল্পনার সূচনা যদি একটি সুসংগঠিত, শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের দিকে পরিচালিত করতে পারে, তবে সেটিই হবে দেশের জন্য। এই পথ কণ্টকাকীর্ণ, কিন্তু অসম্ভব নয়। শুরুতেই প্রয়োজন একঝাঁক দূরদর্শী, ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক মানুষের, যারা দেশকে ভালোবেসে এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করতে এগিয়ে আসবেন। বাংলাদেশ টিকে থাকবে, জয়ী হবে।