বৈষম্য নিরসন ইহকালে সম্ভব নয়

0
8

জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বয়স ইত্যাদির ভিত্তিতে কারো প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণকেই বৈষম্য বলে। বৈষম্যের সাথে মঙ্গল বা অমঙ্গলের সম্পর্ক থাকা বাধ্যতামূলক নয়। কালো কুকুরকে কম খাবার দিয়ে লাল কুকুরকে বেশি খাবার দেওয়ার মধ্যে বৈষম্য থাকলেও এই বৈষম্যে নিপীড়ন নেই, বরং মঙ্গল আছে, কমবেশি হলেও দুই বর্ণের কুকুরই খাবার পাচ্ছে।এখানে বৈষম্য হচ্ছে কালো কুকুরকে লাল কুকুর থেকে কম খাবার এবং ভিন্নতর স্বীকৃতি দেওয়া। তবে ভিন্নতর স্বীকৃতি দিয়ে কালো কুকুরকে অপমান করা হয়েছে এবং এই অপমানটা শুধু বৈষম্য নয়, অমানবিকও।একাধিক স্ত্রীর প্রতি স্বামীর বৈষম্যমূলক আচরণ ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। বয়স ভিত্তিক বিবেচনা করে একাধিক স্ত্রীর সাথে আচরণের ভিন্নতায় বৈষম্য অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হলেও তা জাতিসংঘের ঘোষিত মানবতা বিরোধী অপরাধ নয়।

আইন উপদেষ্টার কথা ও আচরণের মধ্যেও বৈপরীত্যের বৈষম্য রয়েছে; এই বৈষম্য পরিলক্ষিত হয় ক্ষমতা গ্রহণের আগে-পরের কথায়। ২৬ লক্ষ ভারতীয় লোকের চাকুরি নিয়ে তার বক্তব্যের বৈষম্যের কথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন।তার কথার বৈপরীত্য অসংখ্য।বাছবিচার না করে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা রুজু করার প্রেক্ষিতে প্রশ্ন করা হলে আইন উপদেষ্টার সাফ জবাব, ‘স্বৈরাচার’ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে কেউ মামলা করলে সরকার সেখানে বাধা দিতে পারে না এবং অভিযুক্তদের অপরাধের সত্যাসত্য নির্ধারিত হবে শুধু আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।চমৎকার কথা।আইন উপদেষ্টার এমন অকাট্য যুক্তির আইনগত ভিত্তি থাকলেও সামান্য বৈষম্য তৈরি হয়েছে।২০১৮ সনে আওয়ামী লীগ সরকারের কোটা ব্যবস্থা বাতিলের বিরুদ্ধে রিট করেছিলেন কয়েকজন সংক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধা। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার দায়ের করা মামলার দায় এই আইন উপদেষ্টা তখন আওয়ামী লীগ সরকারের উপর চাপিয়ে দিয়ে সরকারকে যৌক্তিক দাবী মেনে নিতে বলেছিলেন কেন? তখন কেন বলেননি, এই আইনি প্রক্রিয়ার সাথে সরকারের কিছু করার নেই।

৩০ বছরের অধিক বয়সীরা চাকুরির জন্য আবেদন করতে পারবে না, বা ৫৯ বছরের অধিক হলে চাকুরির ক্ষেত্রে অনুপযুক্ত হবে- এমন আইন বৈষম্যমূলক বলেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মহাম্মদ ইউনূস আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। মামলায় অবশ্য তিনি হেরে যান, কারণ আইন বলছে কেউ ৬৫ বছরের বেশি বয়সে চুক্তিভিত্তিক চাকুরি করতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে এত বেশি অপরিহার্য হয়ে পড়েছিলেন যে, তাকে চাকুরিতে রাখার জন্য আইন ভেঙ্গে আইন করতে হয়েছিল; কিন্তু ড. ইউনূসের জন্য আইন পরিবর্তন করা হয়নি, এই বৈষম্য ড. ইউনূস নিরসন করতে চেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের মতো বিএনপির আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমেদও বিচারপতির চাকুরির মেয়াদ বর্ধিত করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, বিচারপতিদের বর্ধিত বয়সের অভিজ্ঞতা অপরিহার্য বিবেচিত হলে স্কুল, কলেজের শিক্ষক বা আমলাদের অভিজ্ঞতাও অপরিহার্য। এই বৈষম্য দূর করতেই বোধ হয় সত্তরোর্ধ বয়সের গভর্নর এবং আট বছর পূর্বে অবসর নেয়া আমলাদের চাকুরিতে ফেরত আনা হয়েছে।

কোটা বিরোধী আন্দোলন কখন যে হঠাৎ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে পর্যবসিত হলো তা প্রবীণ আইনজ্ঞ জেড আই খান পান্নাও খেয়াল করেননি। কিন্তু এই নামকরণ সঠিক বলে মনে হয় না। কারণ বৈষম্যের নিরসন আল্লাহর দুনিয়ায় সম্ভব নয়। জাতে তোলার জন্য মহাত্মা গান্ধী মেথরদের নাম দিয়েছিলেন ‘হরিজন’, হরি মানে কৃষ্ণ, অর্থাৎ কৃষ্ণের জন। ’ভগবানের জন’ আখ্যা দিয়েও তিনি তাদের সমাজের অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি।কোটা না থাকায় ভারতের সংবিধান প্রণেতা ভীমরাও রামজি আম্বেদকর তার স্কুল জীবনে তার সতীর্থদের সাথে এক টেবিলে বসে ক্লাস করার সুযোগ পাননি। অস্পৃশ্য, দলিত সম্প্রদায়ের ছেলে বিধায় পিপাসা লাগলে উপর থেকে পিয়ন পানি ঢেলে দিত, পানির পাত্র স্পর্শ করাও ছিল মহাপাপ। ভারতে এই বৈষম্য এখনো বহাল তবিয়তে বিদ্যমান।আমাদের দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং নারী জাতি এখনো সমাজে অবহেলিত ও বঞ্চিত, যতটুকু এগিয়েছে তা কোটার বদৌলতেই। বৈষম্য দূর করার জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ কোটার প্রবর্তন করেছিল।একই কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত কমিটি সরকারি চাকুরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ছেলেদের জন্য ৩৫ এবং মেয়েদের জন্য ৩৭ নির্ধারণ করেছিল; কমিটির এই বৈষম্যমূলক সুপারিশ অবশ্য শেষ পর্যন্ত টিকেনি।তবে তাদের সুপারিশ থেকে প্রতীয়মান হয়, আমাদের সমাজে লিঙ্গ বৈষম্য রয়েছে।

ড. মহাম্মদ ইউনূসের ক্যারিশমায় আমেরিকা বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা ফেরত দেবে বলেছিল।দেখুন, প্রতিযোগিতায় অসমর্থ বাংলাদেশের রপ্তানি করতে জিএসপি সুবিধার কোটা লাগে, কিন্তু অনগ্রসর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও অবহেলিত নারীর কোটা বাদ দেওয়ার জন্য আন্দোলন হয়েছে।প্রকৃতপক্ষে বৈষম্য নিরসনের জন্যই কোটার প্রবর্তন হয়েছিল; কোটা না থাকলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মাঝে বিরাজমান বৈষম্য ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেত।শুধু বাংলাদেশ নয়, সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত লোকদের অগ্রাধিকার দেওয়ার রীতি পৃথিবীর সব দেশ অনুসরণ করে থাকে; এই অগ্রাধিকার না থাকলে বৈষম্যের ফারাক আরও গভীর ও ব্যাপক হতো। প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের সবাইকে এক পরিবারে অন্তর্ভুক্ত করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বৈষম্য দূর না হলে প্রধান উপদেষ্টার ‘এক পরিবার’ গড়ার স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে যাবে। তাই কোটা বা অগ্রাধিকারের কথা এখনো শোনা যায়।

আয়-ব্যয়ের পাহাড়সম বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। ফুটপাতে পলিথিনের ঘর বানিয়ে যারা সংসার পাতে তাদের অনেকে দেহ বিক্রি করে জীবন নির্বাহ করে থাকে; আর যাদের দেহ আকর্ষণীয় নয় তারা ডাস্টবিনে খাবার খোঁজে। ধনধান্যে যারা প্রভাবশালী তাদের নির্যাতনে এই সমাজে দেহ বিক্রি করে খাওয়ারও উপায় নেই। আওয়ামী লীগের নেতা শামীম ওসমানের নেতৃত্বে নারায়নগন্জের টানবাজার থেকে পতিতাদের উচ্ছেদ করার পর কেউ তাদের ডেকে নিয়ে এক বেলা খাবারও দেয়নি।ড.ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও তাদের লাঠি দিয়ে পিটানোর করুণ দৃশ্য মানুষ দেখেছে। বিগত কয়েকদিন ধরে অঘোরে বৃষ্টি হচ্ছে, রাস্তার কুকুরগুলো আমাদের বাড়ির সিড়িতে আশ্রয় নিতে এলে ভাড়াটিয়ারা পিটিয়ে তাড়ায়।যারা তোফাজ্জলকে পিটিয়ে মেরেছে শুধু তারা নয়, অধিকাংশ মানুষই এক এক জন হিটলার।রং ভেদে কুকুরের প্রতি বৈষম্য ধর্মেও আছে, ধর্ম কালো কুকুরের প্রতি বিরূপ। অবশ্য কালো মানুষও বেহেশতে যাবে না। যারা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক তাদের মনোভাব জানা নেই, তবে বেশিরভাগ বর ফর্সা মেয়ে পছন্দ করে থাকে।

সমাজতন্ত্রের উন্নতর স্তর সাম্যবাদে বৈষম্য দূরের একটা ব্যবস্থা ছিল, তাও ধ্বংস করে দিল গর্বাচেব আর আমেরিকা। বৈষম্য রয়েছে আমাদের সংবিধানে, ‘ইসলাম’কে রাষ্ট্রধর্ম করে দেশের মূল আইনে বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে।এই বৈষম্য দূর করার ক্ষমতা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই।আলেম-ওলেমারা হাতের অসমান পাঁচটি আঙ্গুল উঁচু করে তুলে ধরে সাম্যবাদের অসারতা প্রমাণ করতেন।বৈষম্য নিরসনে জাসদ পেশা ভিত্তিক ৫০০ আসনের সংসদের দাবী করেছিল; মাহমুদুর রহমান মান্না ৫০০ আসনের মধ্যেও বৈষম্য আবিস্কার করে জাসদ থেকে বেরিয়ে গিয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ পাশে বক্তৃতা দিয়ে পেশা ভিত্তিক সংসদের অসারতা প্রমাণ করেছিলেন। তার মতে একজন স্থায়ী কুলি আরেকজন অস্থায়ী কুলিকে সহ্য করতে পারে না। স্থায়ী কুলি এবং অস্থায়ী কুলির মতো প্রতিটি বিভাজিত পেশার জন্য পৃথক প্রতিনিধির প্রয়োজন হলে সংসদে আসন লাগবে সহস্রাধিক। একই পেশার বিভাজিত শ্রেণির এই চিত্র প্রকৃতপক্ষে বৈষম্যের চিত্র। এমন হাজারো বৈষম্য নিরসনে একমাত্র নিয়ামক হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘রিসেট বাটন’ টিপ দিয়ে ‘বৈষম্য’ শব্দটি অভিধান থাকে মুছে দেয়া।

লেখক: জিয়াউদ্দিন আহমেদ, সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here