রাজনৈতিক বাধ্য-বাধকতায় ক্ষতির মুখে ‘ভারত-বাংলাদেশ’

0
10

ট্রাম্পের শুল্ক বোমার পর ভারতের রপ্তানি ব্যবসায় যথেষ্ট প্রভাব পড়েছে। যার ফলে চিন্তায় ভারতের রপ্তানিকারকরা। আমেরিকায় বাজার হারানো নিয়ে বেশি চিন্তায় তামিলনাড়ুর পোষাক ও ইন্জিনিয়ারিং শিল্প। চিন্তায় কলকাতা ও তেলেঙ্গানার চর্ম শিল্প। শুধুমাত্র কর্নাটকেই পোষাক শিল্পে কাজ হারাতে পারেন প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক। নয়ডা ও গুরগাঁওয়ের মতন শিল্পাঞ্চলে এর সাময়িক প্রভাব আসতে বাধ্য। ভারতের আভ্যন্তরীণ বাজার বড় হওয়ায় শুল্কের খাঁড়া কিছুটা সামলে নিতে পারবে নরেন্দ্র মোদির ভারত। তবে উৎপাদন শিল্পে যাতে প্রভাব না পরে, সেজন্য জিএসি কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে মোদি সরকার।

মার্কিন মুলুকে ক্ষতি এড়াতে বাংলাদেশের বাজারের দিকে নজর দিতেই পারে ভারত। এই ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদির অবশ্য প্রথম বাধা রাজনৈতিক কারণ। রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা এড়িয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে বাণিজ্য বাড়ালে লাভবান হবে ভারতীয় অর্থনীতি। ভারত থেকে নামমাত্র খরচে বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানি করতে পারে ভারত সরকার। হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে মোদি সরকার দূরত্ব বাড়িয়েছে ইউনূস সরকারের সঙ্গে। রাজনৈতিক কারণে ইউনূস সরকারের সঙ্গে দিল্লি দূরত্ব বজায় রাখবে এটাই স্বাভাবিক। নাহলে বিজেপির ভোট বাক্সে হিন্দু ভোটে প্রভাব পড়তে বাধ্য। যা কখনোই চাইবে না বিজেপি সরকার।

রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতির মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। রাষ্ট্রের অর্থনীতি পরিচালনা করেন রাজনীতিবিদরা। তাই তাদের নেওয়া সিদ্ধান্তে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়লে মানতে বাধ্য হন রাষ্ট্রের জনগণ। ২০২৫ সালে গ্লোবালাইজেশন বা এফডিআর যুগে রাজনীতি ও অর্থনীতির খিচুড়ি তৈরি করলে তা কখনোই সুখকর হবে না। যা কিছুটা টের পাচ্ছে নয়া দিল্লি। তবে এই ক্ষেত্রে ভারত সরকার অপারগ। কারণ বাংলাদেশের ইউনূস ও জামাতকে নিয়ে ভারতীয়দের মধ্যে যথেষ্ট নেতিবাচক ধারনা রয়েছে।

হাসিনার গণঅভ্যুত্থানের পর বাণিজ্য যুদ্ধে ও অবতীর্ণ ভারত ও বাংলাদেশ। ছোট দেশ হওয়ায় ভারত থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব বেশি পড়েছে। মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দাম। ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার বেশি হলেও অর্থনীতির বিরূপ প্রভাব এড়িয়ে যেতে পারছে না ভারত। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ১.৬ বিলিয়ন ডলার তুলা রপ্তানি করেছেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। ভারতের ম্যাঞ্চেষ্টার বলতে নরেন্দ্র মোদির রাজ্য গুজারট। তুলা রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় ক্ষতির মুখে গুজরাটের একাধিক মিল। পাশাপাশি তুলা রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় ভারতীয় স্থলবন্দরগুলিতেও এর প্রভাব পড়েছে। কাজ কমেছে স্থলবন্দরের পরিযায়ি শ্রমিকদের। বাংলাদেশী পণ্যের উপর ট্রানজিট রিমান্ড বন্ধ করায় ভারত থেকে তুলা আমদানি বন্ধ করেছে বাংলাদেশ। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ১.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যবসা করে ভারত। ২০২৫ সালে ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যবসা হয়েছে ভারতের। রাজনীতির প্রতিবন্ধকতা না থাকলে তা আরও বাড়তো বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। চলতি বছর ৮ই এপ্রিলের পর বাংলাদেশে ভারতের পণ্য রপ্তানি কমেছে ৬.১৯%। এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত তিন মাসে ২৬০ কোটি ৯ লাখ ৬০ হাজার ডলারের ব্যবসার ক্ষতি হয়েছে ভারতের। জুনের পর ব্যবসা কমেছে প্রায় ২৭৭ কোটি ২৬ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রকের তথ্য বলছে বাণিজ্যে ঘাটতি প্রায় ৬.১৯%।

প্রসঙ্গত, গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকেই ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য রফতানি নিম্নমুখী হয়ে উঠেছিল। জুলাই-আগস্টেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির প্রভাব পড়েছে দুই দেশের বাণিজ্যে। হাসিনার দেশত্যাগের পর টানা তিনদিন বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ ছিল বাংলাদেশের। ফলে ২০২৪ সালের আগস্টে ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য রফতানি কমেছিল ১৯. ৪৩ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে কমে যায় ১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। তবে অক্টোবরে তা ২ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ে। নভেম্বরে আবারো কমে যায় ৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। ডিসেম্বরে অবশ্য ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য রফতানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে যায়। ওই মাসে বাংলাদেশে ভারতের পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ৩১ দশমিক ৫১ শতাংশ। এরপর জানুয়ারিতেও বাড়ে ১৫ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। তবে ফেব্রুয়ারি ও মার্চে আবার তা নিম্নমুখী হয়। তাই বলা যায় রাজনীতির কু-প্রভাব পড়ছে দুই দেশের অর্থনীতিতে।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সব থেকে বেশি স্থল বন্ধর রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। বাংলার পেট্রাপোল, হিলি, চ্যাংড়াবান্ধা পোর্ট থেকে সবথেকে বেশি বাণিজ্য হয় পদ্মাপাড়ে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য, কৃষিজাত পণ্য, পাথর সহ প্রায় ১০৮টি পণ্য ভারত থেকে রপ্তানি হয় বাংলাদেশ। শুল্ক দপ্তর সূত্রের খবর গণঅভ্যুত্থানের আগে চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্ত থেকে দিনে প্রায় ৭০টির বেশি ট্রাক বাংলাদেশের প্রবেশ করত। তবে বর্তমানে কমে দাঁড়িয়েছে ১৬ টি ট্রাকে। প্রতিদিন ভারতের ক্ষতির পরিমাণ একটি বন্দরে ২ কোটি। প্রতিমাসে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬০ কোটি টাকা। আর বেনাপোল ও হিলির ক্ষতির পরিমাণ লিখলে চক্ষু চড়ক গাছ হয়ে যাবে আপনাদের। তারপরেও রয়েছে অসম ও ত্রিপুরার কয়েকটি স্থল বন্দর। তারমানে বোঝাযাচ্ছে কি পরিমানে লোকসানের মুখে পড়ছে উভয় দেশ।

বাণিজ্যের ঘাটতি কমাতে ভারত ইউরোপ , দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দিকে নজর দিয়েছে। কিন্তুু প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দিকে হাত বাড়ালেই মুশকিল হতে পারে। এখন ভারত সরকারকে ঠিক করতে হবে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা না অর্থনীতিকে প্রাধান্য। অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নতির জন্য ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখাটা জরুরি। ভারত বিরোধী সুর চড়িয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতায় টিকে থাকা হয়তো সহজ হবে ইউনূসের। কিন্তুু ১৮ কোটি বাঙালির হাতে কাজ ও পেটে ভাত দেওয়া মুসকিল হবে।

লেখক: নীল বণিক, এক্সিকিউটিভ এডিটর, নিউজ ভ্যানগার্ড।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here