ঢাকা কলেজে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া উত্তেজনা এখন দেশজুড়ে কর্মবিরতিতে গড়িয়েছে। একইসঙ্গে রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজকে নিয়ে প্রস্তাবিত ‘ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়’ গঠনের খসড়া কাঠামো নিয়ে শিক্ষকদের ক্ষোভের আগুনে নতুন করে ঘি ঢেলেছে। শিক্ষকরা প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোর পরিবর্তন এবং বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসকের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন।
অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করছেন। এমন পরিস্থিতিতে সাত কলেজের শিক্ষা ও প্রশাসনিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।
সাত কলেজ নিয়ে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ গঠনকে কেন্দ্র করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এমনকি শিক্ষার্থীদের মধ্যেও উত্তেজনা দিনদিন বাড়ছে। একদিকে উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা অধ্যাদেশ সংশোধনের দাবিতে রাজপথে অবস্থান ও অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে শিক্ষক সংগঠনগুলো শিক্ষকদের ওপর হামলার অভিযোগ এনে কর্মবিরতি ও কালো ব্যাজ ধারণের ঘোষণা দিয়েছেন। আবার স্নাতকের শিক্ষার্থীরা ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি আইন–২০২৫’ দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে একাট্টা হয়েছেন
অন্য সহপাঠীরা পরে ফরহাদ রেজাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। অভিযোগ উঠেছে, এ সময় উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা টিচার্স লাউঞ্জের জানালার কাঁচ ভাঙচুর করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ফুটেজে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে দৌড়ে এসে স্নাতকের এক শিক্ষার্থীকে মারধর করতেও দেখা যায়।
ঢাকা কলেজের এক শিক্ষক জানান, তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কিছু শিক্ষার্থী আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করায় উত্তেজনা বাড়ে। শিক্ষকরা ফরহাদ রেজাকে ধরে কমনরুমে নিয়ে যান। পরে শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবন ঘেরাও করে সহপাঠীকে ছাড়িয়ে নেন। তিনি জানান, সব বিষয় সংলাপের মাধ্যমে সমাধান হোক— এটাই ছিল শিক্ষকদের চাওয়া। কাউকে হেয় বা অপমান করার কোনো সুযোগ নেই।
বিষয়টি নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানান সাত কলেজ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ও ইডেন মহিলা কলেজের অধ্যাপক মাহফিল আরা বেগম। তিনি বলেন, সোমবার সকালে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের দুটি কর্মসূচি ছিল। একটি ছিল শিক্ষা ভবনের দিকে লংমার্চ। অন্যদিকে, প্রস্তাবিত ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক এবং বর্তমানে অধ্যয়নরত স্নাতকদের ব্যাপারে স্পষ্ট বক্তব্য না থাকা, কলেজের সামগ্রিক কাঠামো বিলুপ্তির আশঙ্কা ইত্যাদি কারণে প্রধানত উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারের দিকে অভিযাত্রার আয়োজন করেন।
গত ১৩ অক্টোবর (সোমবার) সাত কলেজের স্নাতক শিক্ষার্থীরা ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গণে পদযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি টের পেয়ে তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় পাল্টাপাল্টি উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের একপর্যায়ে স্নাতক ২০২২–২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ফরহাদ রেজা শিক্ষকদের লক্ষ্য করে ‘দালাল’ মন্তব্য করেন। উপস্থিত শিক্ষকরা তাৎক্ষণিকভাবে ফরহাদ রেজাকে আটক করে টিচার্স লাউঞ্জের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় শিক্ষার্থীরা বাধা দিলে ধস্তাধস্তি ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে
ঢাকা কলেজে শিক্ষকদের মারধর করা হয়েছে— এমন অভিযোগ এনে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। ঘটনার পরপরই ঢাকা কলেজে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন শিক্ষকরা। সেখানে অনেকেই প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসক অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াসের পদত্যাগ দাবি করেন।
ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. তৌহিদুর রহমান যখন শান্তিপূর্ণভাবে কথা বলতে যান, তখন কিছু ছাত্র তাকে অশ্রাব্য কটূবাক্য উচ্চারণ করে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। এ সময় কলেজে বিপুলসংখ্যক বহিরাগত উপস্থিত ছিল, যারা আক্রমণে অংশ নেয় এবং পরে সংগঠিত হয়ে শিক্ষক লাউঞ্জে আক্রমণ ও ভাঙচুর চালায়। পরে পুলিশ এসে অবরুদ্ধ শিক্ষকদের উদ্ধার করে
অধ্যাপক মাহফিল আরা বেগম, আহ্বায়ক, সাত কলেজ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা কমিটি
পরে রাতে বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশনের যৌথ বিবৃতিতে ঢাকাসহ দেশের সব সরকারি কলেজে সর্বাত্মক কর্মবিরতি ও কালোব্যাজ ধারণ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সচিব ড. মো. মাসুদ রানা খান বলেন, ‘শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহাবস্থান, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সৌহার্দ্য রক্ষাই আমাদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাটি সেই মূল্যবোধকে আঘাত করেছে। আমরা এর সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা চাই। একইসঙ্গে সব শিক্ষককে শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিবাদ জানাতে এবং কালো ব্যাজ ধারণ ও কর্মবিরতির মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান প্রদর্শনের আহ্বান জানাচ্ছি।’
বিসিএস ক্যাডারের শিক্ষকরা মনে করছেন, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোতে তাদের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কর্তৃত্ব খর্ব হবে। অনেক শিক্ষক অভিযোগ করছেন, নতুন কাঠামো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি। আবার উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, নতুন ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি আইন–২০২৫’-এর বর্তমান ধারায় ঢাকা কলেজের ইন্টারমিডিয়েট বিভাগ বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানটির শতবর্ষের ঐতিহ্য নষ্ট হবে বলেও দাবি করেন তারা।
এদিকে, সরকারি সাত কলেজকে পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের অধ্যাদেশ প্রণয়নের প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। দ্রুতই বাকি কাজ শেষ করে অধ্যাদেশ জারি করা হবে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী প্রতিনিধি তানজিমুল আজিজ জানান, অধ্যাদেশের কাজ এখন দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে। যা সবচেয়ে সময়সাপেক্ষ। তবে, এই ধাপ শেষ হলেই প্রায় পুরো কাজ শেষ হবে।
‘আগামী তিন থেকে চার দিনের মধ্যে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে পরামর্শ শেষ করার পর পরবর্তী ধাপ শুরু হবে। এরপর প্রতিটি ধাপ চার দিনের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হবে বলেও কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এরপরও আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে অধ্যাদেশ জারির বিষয়টি দাবি হিসেবে জানিয়েছি। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন এবং বলেছেন, সর্বোচ্চ দ্রুততম সময়ের মধ্যেই অধ্যাদেশের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে— যোগ করেন নাঈম হাওলাদার।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য জানতে চেষ্টা করা হয় ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ও অন্তর্বর্তী প্রশাসক অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস এবং ইউজিসি ও সাত কলেজ বিষয়ক সংশ্লিষ্ট উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খানের কাছে। মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তারা কল রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।