দাবি আদায়ে অনড় শিক্ষকদের অবস্থান শহীদ মিনারে

0
5

বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধিসহ শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনরত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির তৃতীয় দিন বুধবার (১৫ অক্টোবর)। আন্দোলনের অংশ হিসেবে বুধবার রাজধানীর শাহবাগে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ কানায় কানায় পূর্ণ শিক্ষকে। হাতে জাতীয় পতাকা ও বিভিন্ন দাবিদাওয়া লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে তারা স্লোগান দিচ্ছেন। অনেকে আশেপাশের সড়কগুলোর গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিচ্ছেন। এসময় মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের কর্মসূচি চলমান থাকবে।

শিক্ষকরা বলছেন, বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে তারা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। কিন্তু সরকার থেকে এখনো কোনো ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় তারা শ্রেণিকক্ষে পাঠদান বন্ধ রেখে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন।

রাজধানীর শহীদ মিনারে এখনো শতাধিক শিক্ষক অবস্থান করছেন। তাদের অনেকেই জানিয়েছেন, ন্যায্য দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নেবেন না। সারাদেশের বিদ্যালয়গুলোতেও একই কর্মসূচি চলছে— শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকলেও শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করছেন না, বরং আঙিনা বা শিক্ষক লাউঞ্জে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন।

শিক্ষক নেতারা জানিয়েছেন, সরকারের পক্ষ থেকে বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন এবং শিক্ষা জাতীয়করণের রূপরেখা না পাওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি আরও জোরদার করা হবে। ২০ শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়াসহ তিন দফা দাবিতে টানা তিনদিন ধরে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা আন্দোলন করলেও সমাধান দিতে পারছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর্থিক বিষয় হওয়ায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভর করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার বিদেশে থাকায় এ বিষয় নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসছে না।

এর আগে রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার পর সোমবার থেকে সারা দেশে পাঠদান বন্ধ রেখে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু করেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা।

দেশের ৩০ হাজারের বেশি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সবমিলিয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ। এরমধ্যে এমপিওভুক্ত শিক্ষক প্রায় সাড়ে তিন লাখ, আর কর্মচারী দেড় লাখেরও বেশি। বিরাট সংখ্যক এ শিক্ষক-কর্মচারীরা বাড়িভাড়া বাবদ মাসে মাত্র এক হাজার টাকা আর চিকিৎসা ভাতা পান মাত্র ৫০০ টাকা! এই দুই ভাতা ও উৎসব ভাতা (বোনাস) বাড়ানোর দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। তবে কোনো সমাধান দিতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

সবশেষ গত আগস্টে শিক্ষকরা সরকারি চাকরিজীবীদের মতো শতাংশ হারে বাড়িভাড়ার দাবি তোলেন। মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া ভাতা দেওয়ার দাবি জানান তারা। তাদের দাবি উপেক্ষা করে গত ৫ অক্টোবর শিক্ষক দিবসে মাত্র ৫০০ টাকা বাড়িভাড়া ভাতা বাড়ানোর প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। যা যৌক্তিক নয় বলে বলে দাবি তুলেছেন শিক্ষকরা।

গত সোমবার থেকে সারা দেশের সব বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির ডাক দেন। পাশাপাশি শহীদ মিনারে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যান তারা।

মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে ‘মার্চ টু সচিবালয়’ শুরু করেন শিক্ষকরা। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে হাইকোর্ট মোড়ে পৌঁছালে পুলিশ শিক্ষক–কর্মচারীদের আটকে দেয়। সেখানেই সড়কে অবস্থান নেন শিক্ষকরা। এ অবস্থান কর্মসূচি থেকে অনশনের হুঁশিয়ারি দেন শিক্ষক নেতারা।

অবস্থান কর্মসূচিতে বক্তব্যকালে এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণপ্রত্যাশী জোটের সদস্যসচিব অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন আজিজি বলেন, যদি আমাদের দাবি না মানেন, তাহলে আমরা শাহবাগে অবস্থান নেব। তারপরও যদি দাবি না মানা হয়, আমরা যমুনায় যাব। এরপরও দাবি পূরণ না হলে আমরা আমরণ অনশনে বসবো। তিনি আরও বলেন, আমাদের আর পিছু হটার সুযোগ নেই। কারণ, আন্দোলন এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সরকারকে আমাদের দাবি মানতেই হবে এবং এটি আর এখন বাস্তবায়ন না করার সুযোগ নেই। যতক্ষণ দাবি না মানবেন, ততক্ষণ আমরা সচিবালয় ঘেরাও করে রাখবো।

এদিকে, শিক্ষকদের দাবির বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দিকে চেয়ে আছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এ ইস্যুতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অর্থ বিভাগে পাঠানো এক আধা-সরকারি চিঠিতে উৎসব ভাতা ৫০ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশ এবং চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা থেকে ১,০০০ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাইয়েদ এ. জেড. মোরশেদ আলী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি গত ৫ অক্টোবর অর্থ বিভাগের সচিব বরাবর পাঠানো হয়।

চিঠিতে বলা হয়, বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা উৎসব ভাতা বাবদ মূল বেতনের ৫০ শতাংশ, চিকিৎসা ভাতা মাসিক ৫০০ টাকা এবং বাড়ি ভাড়া মাসিক ১,০০০ টাকা হারে পাচ্ছেন।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, শিক্ষক-কর্মচারীরা নির্দিষ্ট টাকার পরিবর্তে মূল বেতনের অন্তত ২০ শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়া ভাতা দেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। তাদের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে সম্ভাব্য আর্থিক প্রভাবের একটি প্রাক্কলন তৈরি করা হয়েছে।

প্রাক্কলন অনুযায়ী, বাড়ি ভাড়া ভাতা ২০ শতাংশ (ন্যূনতম ৩,০০০ টাকা) হারে দিলে ব্যয় হবে প্রায় ৩,৪০০ কোটি টাকা, ১৫ শতাংশ (ন্যূনতম ২,০০০ টাকা) হারে দিলে ২,৪৩৯ কোটি টাকা, ১০ শতাংশ হারে দিলে ১,৭৬৯ কোটি টাকা এবং ৫ শতাংশ হারে দিলে ১,৩৭১ কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, সরকারের আর্থিক সামর্থ্যের আলোকে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য বাড়ি ভাড়াভাতা মূল বেতনের শতকরা হারে নির্ধারণের বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব রেহানা পারভীনের নম্বরে কল দিলেও তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। তবে মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিবেদককে জানান, শিক্ষকদের দাবির ইস্যুগুলো পুরোপুরি আর্থিক। এখানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত লাগবে। সর্বশেষ গত ৫ অক্টোবরও শিক্ষকদের দাবির বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এখন অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে গত শুক্রবার (১০ অক্টোবর) যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন গেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। উপদেষ্টার নেতৃত্বে ১২ সদস্যের সফরকারী দলে রয়েছেন অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদারও। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভা ১৩ অক্টোবর শুরু হয়েছে, যা চলবে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষানীতি গবেষক ও অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, শিক্ষকদের এই আন্দোলন আসলে আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যয় ও নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ার কাঠামোগত দুর্বলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সরকার চাইলে এ মুহূর্তে সব দাবি পূরণ করতে না পারলেও একটি ধাপে ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য নীতিমালা দিতে পারে। এতে শিক্ষক সমাজ আশ্বস্ত হবে এবং অচলাবস্থাও কেটে যাবে। এখন যদি শুধু সময়ক্ষেপণ বা প্রশাসনিক দোহাই দিয়ে বিষয়টি ফেলে রাখা হয়, তাহলে তা শিক্ষাব্যবস্থার ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রাশেদা রওনক খান বলেন, শিক্ষকদের জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম যে সুবিধাটুকু প্রয়োজন, সেটা অবশ্যই রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলতা এখন সময়ের দাবি। তিনি বলেন, শিক্ষকদের জীবিকা টিকে থাকলে শিক্ষার মানও টিকে থাকবে। শিক্ষাব্যবস্থায় উদাসীনতা শুধু নীতির স্তরে নয়, বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপেই দৃশ্যমান। এই মানসিকতা না বদলালে কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, শিক্ষকদের এই আন্দোলন কোনো তাৎক্ষণিক ক্ষোভ নয়, বরং এটা দীর্ঘদিনের অবহেলা ও বৈষম্যের ফল। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দাবি মোটেও অযৌক্তিক নয়। বরং বর্তমান বাজার পরিস্থিতি ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের তুলনায় এই দাবিগুলো বাস্তবসম্মত ও ন্যায্য। এই প্রথাগত উদাসীনতা শিক্ষাব্যবস্থার ভিত দুর্বল করে দিচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here